বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বিবরণ দাও।বারাসাত বিদ্রোহ সম্পর্কে কী জান|টীকা লেখাে- তিতুমিরের বিদ্রোহ।
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বিবরণ দাও।অথবা, বারাসাত বিদ্রোহ সম্পর্কে কী জান?অথবা, টীকা লেখাে- তিতুমিরের বিদ্রোহ।
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন/বারাসাত বিদ্রোহ।
ভূমিকা: ‘ওয়াহাবি’ কথার অর্থ হল নবজাগরণ'। তিতুমির মক্কায় গিয়ে সৈয়দ আহমেদের কাছ থেকে ওয়াহাবি আদর্শ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বাংলায় এসে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন।
[1] তিতুমিরের নেতৃত্ব: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন মির নিশার আলি বা তিতুমির (১৭৮২-১৮৩১ খ্রি.)। তিনি জমিদার ও নীলকরদের হাতেনির্যাতিত দরিদ্র মুসলমানদের নিয়ে একটি বিরাট বাহিনী।গড়ে তােলেন। এতে জমিদার ও নীলকররা আতঙ্কিত ওঠে।
2}ওয়াহাবিদের ওপর অত্যাচার: জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তিতুমিরের সংঘর্ষ শুর হলে ব্রিটিশবাহিনীও তিতুমিরের বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নেমে পড়ে। পুঁড়ার জমিদার কৃয়দেব রায় ঘােষণা করেন যে, কেউ তিতুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে বা দাড়ি রাখলে তাকে জরিমানা দিতে
হবে, কেউ তিতুকে বাড়িতে আশ্রয় দিলে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
3} কুমদেব রায়ের সঙ্গে সংঘর্ষ : বিভিন্ন কারণে তিতুরবাহিনীর সঙ্গে কৃয়দেব রায়ের সংঘর্ষ বাধে। তিতুমির ৩০০ জন অনুগামীসহ কৃয়দেব রায়ের বাড়ি আক্রমণ করলে সংঘর্ষে হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয় এবং বহু পুরােহিত নিহত হন।
4] ‘বাদশাহ’ ঘােষণা : তিতুমির বারাসাতবসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘােষণা করেন। তার শাসনের প্রধানমন্ত্রী হন মৈনুদ্দিন এবং সেনাপতি হন গােলাম মাসুম। তিনি
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ
ভূমিকা: আঠারাে শতকে আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-৯২ খ্রি.)নামে এক ব্যক্তি আরব দেশে ইসলাম ধর্মে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তা ‘ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। আরবের অনুকরণে উনিশ শতকে বাংলায় তিতুমির ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন এই আন্দোলনের বিভিন্ন কারণ ছিল।
ইসলামের শুদ্ধিকরণ:(তিতুমির মনে করতেন যে,বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামধর্মে বহু কুসংস্কার প্রবেশ
করেছে। এজন্য ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে পবিত্র কোরানের নির্দেশ অনুসারে ইসলামকে পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিতুমির শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করেন। )
[2) খাজনা আদায়ে অত্যাচার:(প্রথম জীবনে তিতুমির বিভিন্ন জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীতে কাজ করতেন। এই সময় তিনি খাজনা আদায়ের জন্য দরিদ্র কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখেন।
[3] সংগঠন প্রতিষ্ঠা: তিতুমির জমিদার, মহাজন ।নীলকরদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলিমদের নিয়ে
একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তােলেন। এর ফলে জমিদারও নীলকরদের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ বেধে যায়।
বারাসাত বিদ্রোহের গুরুত্ব|ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব
ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমিরের নেতৃত্বে একই সঙ্গে বিদেশি ইংরেজ শাসন এবং দেশীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। ড. শশীভূষণ চৌধুরীর মতে, “এই আন্দোলন ছিল জমিদার-বিরােধী ও ব্রিটিশ সরকার-বিরােধী গণসংগ্রাম।”
[1] জমিদার-বিরােধিতা: বারাসাত বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল পুঁড়ার জমিদার কৃয়দেব রায়ের সঙ্গে তিতুমিরের বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে। তিতুমির হিন্দু-মুসলিম উভয় শ্রেণির জমিদারদের বিরুদ্ধে তাঁর অনুগামীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। তাই ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন, “তিতুমিরের সংগ্রাম ছিল জমিদারের বিরুদ্ধে।
[2] ব্রিটিশ-বিরােধিতা: বারাসাত বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে শুর হলেও শেষপর্যন্ত তা ব্রিটিশ-বিরােধী বিদ্রোহে পরিণত হয়। বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘােষণা করে তিতুমির নিজেকে বাদশাহ’ বলে।ঘােষণা করেন। ড. শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, “এই
আন্দোলন ছিল প্রবলভাবে ব্রিটিশ বিরােধী।”
[3] কৃষক ঐক্য: ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল কৃষক ঐক্যের একটি মূর্ত প্রতীক। মুসলিম কৃষকরা ছিল এই
আন্দোলনের চালিকাশক্তি। ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন, “এই বিদ্রোহ হল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এক কৃষকবিদ্রোহ।”
[4] নিম্নবর্গের শ্রেণিসংগ্রাম : তিতুমিরের ডাকে সমাজের নিম্নবর্গের দরিদ্র মানুষ বারাসাত বিদ্রোহে শামিল হয়। বহু দরিদ্র হিন্দু কৃষকও আন্দোলনকে সমর্থন করে। তাই ড.রণজিৎ গুহ বলেছেন যে, “এই আন্দোলন ছিল নিম্নবর্গের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই।”
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য কী ছিল?
ভূমিকা: উনিশ শতকে তিতুমিরের নেতৃত্বে মুসলিমদের মধ্যে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় তা ওয়াহাবি
আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যেমন—
[1] শুদ্ধিকরণ: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইসলামের কুসংস্কারগুলি দূর করা এবং পবিত্র কোরান-নির্দেশিত পথে ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটানাে।
[2] জমিদার-বিরােধিতা: ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের আধিপত্য ধ্বংস করা।
[3] ব্রিটিশ-বিরােধিতা: ইংরেজ কোম্পানি যেহেতু বাংলার অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের রক্ষাকর্তা ছিল সেহেতু ওয়াহাবি আন্দোলন শীঘ্রই ব্রিটিশ-বিরােধী আন্দোলনে পরিণত হয়।
[4] স্বাধীনতা : ওয়াহাবি আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বিদেশি ব্রিটিশ শাসন ও দেশীয় জমিদারদের আধিপত্য ধ্বংস করে স্বাধীনতা এবং নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা।