মুন্ডা বিদ্রোহ|প্রধান কারণ |ফলাফল|প্রকৃতি বা চরিত্র|বৈশিষ্ট্য|দশম শ্রেণি ইতিহাস|প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

WhatsAp Group Join Now
Telegram Group Join Now

মুন্ডা বিদ্রোহ|প্রধান কারণ |ফলাফল|প্রকৃতি বা চরিত্র|বৈশিষ্ট্য|দশম শ্রেণি ইতিহাস|প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ


মুন্ডা বিদ্রোহের কারণগুলি কী ছিল?

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ

ভূমিকা: ভারতের প্রাচীনতম আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এক শক্তিশালী বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন—

[1] যৌথ মালিকানা বাতিল: ব্রিটিশ শাসনের আগে মুন্ডা অধ্যুষিত অঞলে ‘খুঁৎকাঠি প্রথা অনুসারে জমিতে যৌথ মালিকানা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে এই যৌথ মালিকানা ব্যবস্থা বাতিল করে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়।


[2] মুন্ডাদের ঐতিহ্য বাতিল: মুন্ডা অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্রিটিশ

শাসন চালু হওয়ার পর এখানে মুন্ডাদের চিরাচরিত আইন, শাসন ও বিচারব্যবস্থা বাতিল করে নতুন ব্যবস্থা চালু করা হয়।

[3] কর আরােপ: সরকার ও বহিরাগত জমিদাররা মুন্ডাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর চাপিয়ে দেয় এবং তা আদায়ে অত্যাচার চালায়।


[4] বেগার শ্রম: সরকারি কর্মচারী ও বহিরাগত জমিদাররামুন্ডাদের বিনা বেতনে বেগার হিসেবে খাটতে বাধ্য করে।


[5] জমি দখল; বহিরাগত জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে মুন্ডাদের ঠকিয়ে তাদের জমি দখল করে নিতে থাকে।


[6] চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক: দেশীয় ও ইউরােপীয় ঠিকাদাররা নানা প্রলােভন দেখিয়ে মুন্ডাদের চুক্তির মাধ্যমে আসামের চা- বাগান-সহ বাইরে বিভিন্ন স্থানে কাজে নিয়ােগ করত এবং সেখানে তাদের ওপর নানা ধরনের শােষণ ও অত্যাচার চালাতাে।


[7] ধর্মান্তকরণ: খ্রিস্টান মিশনারিরা নানা কৌশলে মুন্ডাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করত।



মুন্ডা বিদ্রোহের ফলাফলগুলি কী ছিল?


মুন্ডা বিদ্রোহের ফলাফল

ভূমিকা: মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রি.) ভারতের ব্রিটিশ- বিরােধী এক শক্তিশালী আদিবাসী বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের ফলাফলগুলিকে মােটেই অস্বীকার করা যায় না।


[1] সমস্যার সমাধান: বিদ্রোহের পর থেকে সরকার মুন্ডাদের অভাব-অভিযােগগুলি গুরুত্ব দিয়ে উপলদ্ধি করার এবং সমাধানের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে।


[2] টেন্যান্সি অ্যাক্ট: সরকার মুন্ডাদের দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ছােটোনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট (১৯০৮ খ্রি.) পাস করে। এর দ্বারা সরকার মুন্ডাদের কিছু সুবিধা দেয়।


[3] খুল্কাঠি প্রহার স্বীকৃতি : সরকার মুন্ডা সমাজে প্রচলিত খুঁৎকাঠি প্রথা অর্থাৎ জমিতে মুন্ডাদের যৌথ মালিকানা স্বীকার করে নেয়। এ ছাড়া সরকার জমি থেকে মুন্ডাদের উচ্ছেদ নিষিদ্ধ করে


[4] বেগার শ্রম। নিষিদ্ধ : সরকার মুন্ডাদের দিয়ে বিনা বেতনে বেগার খাটানাে নিষিদ্ধ করে। ফলে মুন্ডারা শােষণ থেকে মুক্তি পায়।


[5] একতার সৃষ্টি: বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে মুন্ডাদের মধ্যে এক গভীর একতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিরসা মুন্ডা প্রথমে নতুন ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং পরে বিদ্রোহ শুরু হলে সেই ঐক্য আরও শক্তিশালী হয়।


[6] বিরসা সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ: বিদ্রোহের পর বিরসার অনুগামীদের নিয়ে বিরসা সম্প্রদায়’ নামে একটি উপজাতি শাখার আত্মপ্রকাশ ঘটে।


[7] তানা ভগৎ, আন্দোলন: মুন্ডা বিদ্রোহের প্রভাবে ছােটোনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী ওঁরাও সম্প্রদায়ের ভাইয়ারা জমির মালিকানা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তানা ভগৎ'। আন্দোলনের সূচনা করে।


[8] দ্রুমি ছারপ: সরকার মুন্ডা এলাকায় জমি জরিপ করে। ফলে নিজেদের জমিতে মুন্ডাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।



মুন্ডা বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?


মুন্ডা বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য

ভূমিকা: ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ছােটোনাগপুর ও তার সন্নিহিত অঞলের মুন্ডারা বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা মুন্ডাদের ভাষায় ‘উলঘুলান’ বা ‘ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা’ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যেমন—

[1] আদিবাসী বিদ্রোহ: মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল মূলত আদিবাসী মুন্ডাদের দ্বারা পরিচালিত একটি বিদ্রোহ। মুন্ডারাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রাণশক্তি।


[2] জমির মালিকানা: মুন্ডারা নিজেদের চাষ করা জমিতে জমিদারদের মালিকানা অস্বীকার করে এবং জমিতে নিজেদের মালিকানার দাবি জানায়।


[3] মুক্তির উপায় : মুন্ডারা শােষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে প্রথমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মহারানি ভিক্টোরিয়ার কাছে আবেদন জানায়। কিন্তু তাতে কোনাে কাজ না হলেতারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।


[4] ব্রিটিশ বিরােধিতা : ব্রিটিশ শক্তির বিরােধিতাই ছিল মুন্ডা বিদ্রোহীদের মূল লক্ষ্য। বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ সরকারের অফিস, থানা প্রভৃতি আক্রমণ করে।


[5] দিক বিরােধিতা: বিদ্রোহী মুন্ডারা ব্রিটিশদের সহযােগী বহিরাগত দিকু’ অর্থাৎ জমিদার, মহাজন

ব্যবসায়ীদেরও বিরােধিতা করে এবং মুন্ডা অঞ্চল থেকে তাদের বিতাড়নের কথা ঘােষণা করে।


[6] স্বাধীনতী: বিরসা মুন্ডা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি মুন্ডাদের নিয়ে স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করেন।



মুন্ডা বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র বিশ্লেষণ করাে।


মুন্ডা বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র

ভূমিকা: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের ব্রিটিশ-বিরােধী আন্দোলনগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ছিল মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রি.)। এই বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র ছিল। বহুমুখী। যেমন—


[1] ঐক্য: বিরসার নেতৃত্বে মুন্ডাদের ঐক্য ছিল চোখে পড়ার মতাে। বিরসা প্রথমে নতুন ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে মুন্ডাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরে প্রবল বিদ্রোহের সময় এই ঐক্য আরও জোরদার হয়। পরবর্তীকালে বিদ্রোহের অবসান ঘটলেও বিরসার ঐক্যবদ্ধ অনুগামীরা ‘বিরসাইট’ বা বিরসা সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করে।


[2] আদিবাসী বিদ্রোহ: মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল মূলত একটিআদিবাসী বা উপজাতি বিদ্রোহ। কারণ আদিবাসী   মুন্ডারাই ছিল এই বিদ্রোহের চালিকাশক্তি।


[3] কৃষকবিদ্রোহ: মুন্ডা বিদ্রোহে মূলত কৃষকরা অংশ নিয়েছিল। এজন্য অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ মুন্ডা

বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন।


[4] ব্রিটিশ বিরােধিতা: মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল ভারতের ব্রিটিশ- বিরােধী একটি গণসংগ্রাম। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানােই ছিল বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য।


[5] স্বাধীনতার দাবি: মুন্ডা বিদ্রোহে স্বাধীনতার দাবি খুবই স্পষ্ট ছিল। বিরসা মুন্ডা বিদেশিদের বিতাড়িত করে স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করেন।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url