চুয়াড় বিদ্রোহের বিবরণ দাও।চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ ও প্রসার সম্পর্কে আলােচনা

WhatsAp Group Join Now
Telegram Group Join Now

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ ও প্রসার সম্পর্কে আলােচনা

অথবা, চুয়াড় বিদ্রোহের বিবরণ দাও।


চুয়াড় বিদ্রোহের বিবরণ

ভূমিকা: ভারতের আদিবাসী চুয়াড় বা চোয়াড় জনগােষ্ঠী বাংলার বর্তমান মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ ও বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে বসবাস করত। তারা কৃষিকাজ ও পশুশিকারের পাশাপাশি স্থানীয় জমিদারদের অধীনে পাইক বা সৈনিকের কাজ করত। জমিদারের কাজের বিনিময়ে তারা কিছু নিষ্কর জমি ভােগ করত। এই চুয়াড়রা ইংরেজদের শােষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত।


[1] দুটি পর্ব: চুয়াড় বিদ্রোহ অন্তত তিন দশক ধরে চলে

বিদ্রোহ দুটি পর্বে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

  • i. প্রথম পর্ব: প্রথম পর্বের বিদ্রোহ ১৭৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়।

  • ii. দ্বিতীয় পর্ব: দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ শুরু হয়।১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে।

[2] প্রথম পর্বের বিদ্রোহের কারণ: প্রথম পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল—

i. জীবিকা সমস্যা : ব্রিটিশ কোম্পানি চুয়াড়দের অধিকাংশ জমিজমা কেড়ে নিলে তাদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে।

ii. রাজস্ব বৃদ্ধি; কোম্পানি চুয়াড়দের কৃষিজমির ওপর রাজস্বের হার যথেষ্ট বাড়িয়ে দেয়।

ii. অত্যাচার; রাজস্ব আদায়কারী ও সরকারি কর্মচারীরা চুয়াড়দের ওপর চরম অত্যাচার চালাতে শুরু করে।

[3] প্রথম পর্বের বিদ্রোহ: ঘাটশিলা ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন।চুয়াড়রা এই বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে যােগ দেয়। শেষপর্যন্ত চুয়াড়রা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে তারা ধাদকার শ্যামগঞ্জ-এর নেতৃত্বে আবার বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু এই বিদ্রোহও ব্যর্থ হয়।


[4] দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহের কারণ: দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড়বিদ্রোহের (১৭৯৮-৯৯ খ্রি.) বিভিন্ন কারণ ছিল—


i. নির্যাতন : ব্রিটিশ সরকার ও তাদের কর্মচারীরা আদিবাসী চুয়াড় এবং স্থানীয় জমিদারদের ওপর নির্যাতন শুরু করে।

ii. জমি থেকে উৎখাত : প্রথম পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে ইংরেজরা দরিদ্র চুয়াড়দের জমির মালিকানা বাতিল করে তাদের জমি থেকে উৎখাত করে।

iii. পেশা থেকে বিতাড়ন : সরকার বহু চুয়াড়কে তাদের পাইকের পেশা থেকে বিতাড়িত করে।

iv. রাজস্ব বৃদ্ধি : জমিদারদের ওপর রাজস্বেরপরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে জমিদার ও চুয়াড় কৃষকরা ক্ষুদ্ধ হয়।


[5] দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ: জঙ্গলমহলসহ মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞলে দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে বাঁকুড়ার রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিং, মেদিনীপুরের রাণি শিরােমণি প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। তারা বিভিন্ন জমিদার ও আদিবাসী চুয়াড়দের বিদ্রোহে শামিল করতে সক্ষম হন। প্রায় ১৫০০ অনুগামী নিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং চুয়াড়রা প্রায় ৩০টি গ্রামে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্রোহে অসামান্য অবদানের জন্য রানি শিরােমণি ‘মেদিনীপুরের লক্ষ্মীবাঈ’ নামে পরিচিত হন।


[6] বিদ্রোহের অবসান: প্রবল বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ পুলিশ ও কর্মচারীরা বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র রায়পুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু শীঘ্রই পরিস্থিতি পালটে যায়। সশস্ত্র ব্রিটিশ সেনা এসে বিদ্রোহী জমিদার ও আদিবাসী চুয়াড়দের পরাজিত করে। রানি শিরােমণিকে হত্যা এবং দুর্জন সিংকে গ্রেফতার করা হয়। এর ফলে বিদ্রোহ থেমে যায়।

.

উপসংহার: চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ। ফলাফল লক্ষ করা যায়। যেমন-

[1] বিদ্রোহের দৃষ্টান্ত : ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে পশ্চাদপদ চুয়াড়রা বিদ্রোহ শুরু করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।


[2] জমিদার ও কৃষকদের একতা : এই বিদ্রোহে জমিদার ও কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহে শামিল হয়।

[3] জগলমহল জেলা গঠন: চুয়াড়দের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সরকার এখানকার শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটায়। বিষ্ণুপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল নামে একটি বিশেষ জেলা গঠন করা হয়।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url