আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রবন্ধ রচনা|Antarjatika matribhasa dibasa prabandha racana PDF
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রবন্ধ রচনা PDF
ভূমিকা: বিশ্বের ইতিহাসে ২১ ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। মাতৃভাষাপ্রেমী সকল মানুষের কাছে এই দিনটি হল শপথের, সংগ্রামের এবং ন্য বাকৃতির এক উজ্জ্বল প্রতীক। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ৪ দিবস। এই দিনটি মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা জানাবার দিন,মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষার প্রতিজ্ঞা করার দিন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী চাকায় একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদারক্ষার জন্য বরকত, রফিক, সালাম, জব্বার, শফিউর রহমান এবং আরও অনেকে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। মাতৃভাষার জন্য প্রাণদানের এই দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করে| মাতৃভাষাপ্রেমী শহিদদের এই প্রাণ বিসর্জন অবশ্য ব্যর্থ হয়নি। রক্তে রাঙানাে ২১ ফেব্রুয়ারির অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত মানুষের মধ্যে তুমুল ভাষা-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলা। শেষপর্যন্ত এই ভাষার ওপর ভিত্তি করেই জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন ও যাত্মবলিদানের এই বিরল দৃষ্টান্তের কথা মনে রেখে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ইউনেস্কো (UNESCO)-র পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘােষণা করা হয়।
প্রেক্ষাপট : ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতালাভের সঙো সঙ্গে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল। জন্ম হয়েছিল নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের। পাকিস্তানের দুটি অংশ—পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান | অবিভক্ত বঙ্গভূমির পূর্ব দিকের শতকরা ৬২ ভাগ নিয়ে গঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান | আর পাস্রাবের পশ্চিম অংশ, সিধু, বালুচিস্তান প্রভৃতি নিয়ে গঠিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান। আয়তনের দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান বড়াে হলেও পূর্ব পাকিস্তানের লােকসংখ্যা ছিল বেশি। পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষই ছিল বাংলাভাষী। সেজন্য দেশবিভাগের পূর্বে ড. মহম্মদ শহিদুল্লাহর মতাে পণ্ডিত ব্যক্তি বাংলা ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত বলে দাবি জানিয়েছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের পক্ষ থেকেও ১৯৪৬ সালে ঘােষণা করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা| কিন্তু কার্যত তা হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী রাষ্ট্রপ্রধানদের ইচ্ছানুসারে পশ্চিম পাকিস্তানের মতাে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবেও উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-শিক্ষক বুদ্ধিজীবীগণ প্রথম থেকেই প্রতিবাদে সােচ্চার হন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'। এই পরিষদের দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত স্তরে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং উর্দুর সঙ্গে বাংলাও হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি নিয়ে আন্দোলন ও নানা আলাপ-আলােচনা চলতে থাকে। ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান জানিয়ে দেন যে, বাংলা নয়, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এতে বাংলা ভাষার জন্য এই আন্দোলন ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস: ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে ঘােষণা করা হয়, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই ঘােষণার পরে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ বৃহত্তর আন্দোলনে নামেন। দিকে দিকে শুরু হয় বিক্ষোভ ও ধর্মঘট। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই দিন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডাক দেওয়া হয় ধর্মঘটের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি প্রতিবাদ সভার আয়ােজন করা হয়। এদিকে আগের দিন বিকেল থেকেই ঢাকায় সভাসমাবেশের বিরুদ্ধে জারি করা হয় কঠোর নিষেধাজ্ঞা| ২১ ফেব্রুয়ারি সেই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। প্রথমে পুলিশ লাঠি চালায় ও কঁাদানে গ্যাস ছোড়ে। কিন্তু তাতে ছাত্রদল পিছু না হটায় পুলিশবাহিনী নির্মমভাবে গুলি চালায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বরকত, রফিক, সালাম, জব্বার ও শফিউর রহমানেরা |
আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের গুরুত্ব : ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার যে উদ্যোগ ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে গৃহীত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে সাধুবাদযােগ্য | বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষের কাছেই নিজের মাতৃভাষা পরম সমাদরের বস্তু। মাতৃভাষাই আত্মপ্রকাশের যথার্থ মাধ্যম। মাতৃভাষার অপমান সহ্য করা আত্ম- অবমাননার নামার আপন ভাষার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব সকল দেশের সকল মানুষের | ২১ ফেব্রুয়ারির মতাে একটি ঐতিহাসিক দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার মধ্য দিয়ে প্রতিটি মানুষকে তার মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্বশীল করে তােলার একটি শুভ প্রচেষ্টা নিহিত আছে।
উপসংহার: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে| তবে মনে রাখতে হবে, এটি যেন কখনােই কেবল একটি তিথি পালনের প্রথায় পর্যবসিত না হয়। শুধু আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এই দিনটিকে স্মরণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এই দিনটিকে তখনই আমরা প্রকৃত অর্থে সম্মান জানাতে পারব, যখন আমরা সবাই নিজের নিজের মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধিসাধনে তৎপর হয়ে উঠব। খুবই দুঃখের কথা, কোনাে কোনাে জায়গায় মাতৃভাষা আজও উপেক্ষিত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সেই উপেক্ষা কাটিয়ে ওঠার দিন, মাতৃভাষার গৌরব প্রতিষ্ঠায় শপথ নেওয়ার দিন।
.
অনুসরণে লেখা যায়
- আ মরি বাংলা ভাষা’ অমর একুশে
- একুশে ফেব্রুয়ারি [