কন্যাশ্রী প্রকল্প প্রবন্ধ রচনা pdf| Kanyashree prakalpa prabandha racana pdf|
প্ৰবন্ধ- কন্যাশ্রী প্রকল্প প্রবন্ধ রচনা pdf| Kanyashree prakalpa prabandha racana pdf|
ভূমিকা:
“আমরা তো জানি পৃথিবী রমণী আকাশ আদিম পুরুষ
তবে কেন তুমি আমার দুহাতে শেকল পরিয়ে রেখেছ?
হাজার বছর ধরে কেন তুমি সূর্য দেখতে দাওনি?
[মল্লিকা সেনগুপ্ত]
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হল প্রজাকল্যাণসাধন। সমাজে আর্থিক বৈষম্য দূর করা, শিক্ষা এবং খাদ্য বস্ত্র- বাসস্থানের অধিকারকে নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারের পরিকল্পনা তৈরি হয় এইসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই। ২০১৩ সালে প্রবর্তিত ‘কন্যাশ্রী প্রকল্প’ এই উদ্দেশ্যসাধনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
প্রেক্ষাপট: কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে রয়েছে সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনার এক করুণ ইতিহাস। ২০১১ র জনগণনায় দেখা গিয়েছে যে পশ্চিমবাংলায় বয়ঃসন্ধিকালীন মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ৭৩ লক্ষ। এর মধ্যে ৪৮.১১ শতাংশই হচ্ছে মেয়ে। আবার পশ্চিমবাংলার মোট জনসংখ্যার ৯.৩ শতাংশ হচ্ছে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়ে, আর ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৯.৫ শতাংশ। কিন্তু এই যে বিপুল নারীশক্তি, তাদের জীবনবিকাশের পথ কিন্তু একেবারেই মসৃণ নয়। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার এবং লিঙ্গগত বৈষম্যের শিকার হয়ে এদের বিরাট অংশকে জীবন কাটাতে হয়, অনেকেই হারিয়ে যায় সমাজের অন্ধকারে। UNICEF-এর সমীক্ষায় শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ের নিরিখে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবাংলার স্থান তৃতীয়। পরিসংখ্যান অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের মধ্যে ৫৪.৭ শতাংশই দ্রুত বিবাহের শিকার। গ্রামীণ এলাকায় সংখ্যাটা আরও বেশি—৫৭.৯ শতাংশ। এই দ্রুতবিবাহের ফলে একদিকে যেমন এইসব মেয়েরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনি তারা নানারকম অপুষ্টির শিকার হয়, যা পরবর্তী প্রজন্মকেও প্রভাবিত করে। মেয়েদের এই দুর্দশা সামাজিক প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অবস্থা কতটা শোচনীয় তা স্পষ্ট হয় যখন পরিসংখ্যানে দেখা যায় স্কুলছুটদের ৬৩.৫ শতাংশই হল মেয়ে। সমাজের দুর্বল, পিছিয়ে পড়া এবং হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাওয়া এইসব মেয়েদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার চালু করে কন্যাশ্রী প্রকল্প, যার ঘোষিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়— “To reduce dropout rate and prevent early marriage" |
প্রকল্পের রূপরেখা: ১০ থেকে ১৮ বছর বয়স এই সময়কালকে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বলেছে মানুষের জীবনগঠনের কাল। কন্যাশ্রী প্রকল্পের ভাবনাও এই বয়সকে পরিচর্যা করার জন্যই। নারী এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রক জানিয়েছে যে, যে সব মেয়েদের পরিবারের বার্ষিক আয় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা বা তার কম, তারা বছরে ৫০০ টাকা করে আর্থিক সাহায্য পাবে এবং ১৮ বছর অবধি পড়া চালিয়ে গেলে ১৮ বছর বয়সে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরকার ২৫ হাজার টাকা প্রদান করবে। ২০১৫ সালের রাজ্য বাজেটে এই বৃত্তির পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা করা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে যেখানে ২৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল ২০১৫- ১৬ তে তা বেড়ে হয়েছে ৮৫০ কোটি। ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা আজও যথেষ্ট, সেখানে মেয়েদের সামাজিক সুরক্ষায় এই প্রকল্প যে যথেষ্ট কার্যকরী তা বলাই বাহুল্য। সরকারি তথ্য অনুসারে প্রায় ২২ লক্ষ মেয়ে ইতিমধ্যেই এর দ্বারা উপকৃত।
উপসংহার: কন্যাশ্রী প্রকল্প শুধু দেশের মধ্যে নয়, গোটা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ২০১৪ সালে UNICEF-এর মেয়েদের জন্য অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে লন্ডনে রাজ্যকে কন্যাশ্রী প্রকল্প সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে রাজ্যকে সরকার ১৪ আগস্ট দিনটিকে ‘কন্যাশ্রী দিবস’ রূপে ঘোষণা করেছে। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কন্যাশ্রী প্রকল্পকে ভবিষ্যতে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার কথাও ঘোষণা করেছেন। প্রশাসনিক সদিচ্ছা আর সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই কন্যাশ্রীর মতো অসামান্য প্রকল্প আরও অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।