1. নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির বর্ণনা করো। [মাধ্যমিক '09, '12]
● উত্তর : নদীর ক্ষয়জাত ভূমিরূপ
উৎস থেকে মোহানা পর্যন্ত নদী তার গতিপথে তিনটি কাজ করে—ক্ষয়, বহন এবং সঞ্চয় | এগুলির মধ্যে নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে যেসব ভূমিরূপ গঠিত হয় সেগুলি হল—
‘I’-আকৃতির উপত্যকা ও ক্যানিয়ন: শুষ্ক ও প্রায় শুষ্ক পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে ‘I’-আকৃতির নদী উপত্যকার সৃষ্টি হয়। কারণ, বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার জন্য নদী উপত্যকাগুলির পার্শ্বদেশের বিস্তার কম, কিন্তু ভূমির ঢাল বেশি হওয়ায় নদীগুলির নিম্নক্ষয় বেশি হয় | এজন্য নদী উপত্যকা সংকীর্ণ ও গভীর হয়ে ইংরেজি ‘I’ অক্ষরের মতো দেখতে হয় | শুষ্ক অঞ্চলে গভীর ‘I’-আকৃতির উপত্যকাকে ক্যানিয়ন বলা হয়।
যেমন—কলোরাডো নদীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন (গভীরতা প্রায় 1857 মি)।
‘V’আকৃতির উপত্যকা ও গিরিখাত: আর্দ্র ও আর্দ্রপ্রায় অঞ্চলে নদীর ঊর্ধ্ব বা পার্বত্য প্রবাহে ভূমির ঢাল অধিক থাকায় নদীগুলি প্রবলভাবে
নিম্নক্ষয় করে । এরূপ নিম্নক্ষয়ের কারণে নদী উপত্যকাগুলি যেমন সংকীর্ণ ও গভীর হয়ে ওঠে তেমনি আবহবিকার, পুঞ্জিত ক্ষয় ইত্যাদির প্রভাবে কিছু পরিমাণ পার্শ্বক্ষয়ও চলে। ফলে নদী উপত্যকা পূর্বাপেক্ষা চওড়া হয়ে ‘V’ আকৃতি ধারণ করে। অতিগভীর ‘V’-আকৃতির উপত্যকাকে বলা হয় গিরিখাত | যেমন—নেপালের কালী নদীর গিরিখাত।
জলপ্রপাত : নদীর গতিপথে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর ওপর-নীচে আড়াআড়িভাবে থাকলে প্রবল স্রোতে কঠিন ও কোমল শিলার সন্ধিস্থল উন্মুক্ত হয় এবং ওপরের কঠিন শিলাস্তর ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হলে নীচের কোমল শিলাস্তর বেরিয়ে আসে। কোমল শিলাস্তর দ্রুত ক্ষয় পাওয়ার কারণে নদীস্রোত হঠাৎ খাড়া ঢাল সৃষ্টি করে প্রবল বেগে নীচে পড়ে। একেই বলা হয় জলপ্রপাত। উদাহরণ—ভেনেজুয়েলার ক্যারোনি (Caroni) নদীর উপনদী চুরান (Churun) নদীর গতিপথে সৃষ্ট অ্যাঞ্জেল প্রপাতটি পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত |
পটহোল বা মন্থরূপ : পার্বত্য অঞ্চলে প্রবল স্রোতের সঙ্গে বাহিত বড়ো বড়ো পাথরের সঙ্গে নদীখাতের সংঘর্ষের ফলে অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় নদীর বুকে মাঝে মাঝে যে গোলাকার গর্ত সৃষ্টি হয়, সেগুলিকে বলা হয় পটহোল বা মন্থকূপ। উদাহরণ—দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লাইড নদীখাতে অনেকগুলি মন্থকূপের সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা নদীর পার্বত্য প্রবাহেও মন্থকূপ দেখা যায় |
শৃঙ্খলিত শৈলশিরা : পার্বত্য অঞ্চলে অনেক সময় কঠিন শিলাগঠিত শৈলশিরাসমূহ নদীর গতিপথে এমনভাবে বাধার সৃষ্টি করে যে, সেই বাধা এড়াতে নদী শৈলশিরাগুলির পাদদেশ ক্ষয় করে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। তখন পরপর অবস্থিত ওই শৈলশিরাগুলিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ওগুলি যেন একত্রে শৃঙ্খলিত বা আবদ্ধ হয়ে আছে| একেই বলা হয় শৃঙ্খলিত শৈলশিরা।
কর্তিত শৈলশিরা : পার্বত্য প্রবাহে নদী উপত্যকার দুই পাশের বহিঃপ্রসূত বা নদীর দিকে বেরিয়ে থাকা শৈলশিরাগুলির 'সামনের অংশটি নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে ক্রমশ মসৃণ হয়ে যায়। এই ধরনের শৈলশিরাগুলিকে বলে কর্তিত শৈলশিরা | হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা প্রভৃতি নদীর গতিপথে এই ধরনের শৈলশিরা দেখা যায় |
2. জলপ্রপাত সৃষ্টির কারণগুলি আলোচনা করো
জলপ্রপাত সৃষ্টির কারণ
পৃথিবীতে ছোটো-বড়ো অসংখ্য জলপ্রপাত আছে | সেগুলি বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়েছে | কারণগুলি হল—
চ্যুতি : নদীর গতিপথে হঠাৎ কোনো চ্যুতি গঠিত হলে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয়। এর ফলে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয় |
শৈলশিরার অবস্থান: অনেক সময় দেখা যায়, নদীর গতিপথে কঠিন লাভা শৈলশিরার ন্যায় অবস্থান করছে। এর ফলে ঢালের তারতম্যজনিত কারণে অনেক সময় জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয় |
ভূ-আন্দোলন: ভূ-আন্দোলনের ফলে কোনো স্থানে হঠাৎ খাড়া ঢালের সৃষ্টি হতে দেখা যায় | এইরূপ স্থানের ওপর দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে সেখানে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয় |
ঝুলন্ত উপত্যকা : পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে ঝুলন্ত
উপত্যকার সৃষ্টি হয় | এই ঝুলন্ত উপত্যকার অগ্রভাগে খাড়া ঢাল থাকায় এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়।
শিলাস্তরের বিন্যাস: ভূপৃষ্ঠের সব অংশ একই ধরনের শিলা দ্বারা
গঠিত হয় না। এর ফলে পাশাপাশি কঠিন ও কোমল শিলার ওপর দিয়ে নদী যখন প্রবাহিত হয় তখন কোমল শিলায় অধিক ক্ষয় করে খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে এবং জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
3. নদীর মোহানায় বদ্বীপ সৃষ্টির ভৌগোলিক কারণগুলি লেখো।
● উত্তর : নদীর মোহানায় বদ্বীপ সৃষ্টির ভৌগোলিক কারণ
সব নদীর মোহানায় বদ্বীপ গড়ে ওঠে না। কয়েকটি বিশেষ ভৌগোলিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে বদ্বীপ গড়ে ওঠে—
পলিরাশির পরিমাণ : নদী অববাহিকা বৃহৎ, নদীর প্রবাহপথ দীর্ঘ ও নদী অববাহিকা অঞ্চলের শিলা নরম প্রকৃতির হলে এবং অনেক উপনদী ওই নদীতে এসে মিশলে ওইসব নদীতে পলির পরিমাণ বেড়ে যায় | ফলে নদীর জল অতিরিক্ত পলিসমৃদ্ধ হয়ে বদ্বীপ সৃষ্টি সম্ভব হয় |
সমুদ্রের ঢেউ ও জোয়ারভাটা : নদীমোহানায় জোয়ারভাটার প্রকোপ থাকলে এবং ঢেউয়ের তীব্রতা কম হলে দ্রুত বদ্বীপ গড়ে উঠতে পারে।
আবহাওয়া ও জলবায়ু : যেসব নদীর মোহানায় নদীর স্রোতের বিপরীতে বায়ুপ্রবাহ হয় সেখানে দ্রুত পলির অধঃক্ষেপণ ঘটে। তাই দ্রুত বদ্বীপ গড়ে ওঠে। আবার উম্ন-আর্দ্র জলবায়ুতে নদনদীর সংখ্যা বেশি থাকে বলে সেখানে বদ্বীপের সংখ্যাও বেশি হয়।
অগভীর উপকূলভাগ : উপকূলভাগ অগভীর হলে দ্রুত পলি দ্বারা ভরাট হয়ে বদ্বীপ তৈরি হয়। ভারতের পূর্ব উপকূল অগভীর বলে বদ্বীপের সংখ্যাও বেশি।
জলের ঘনত্ব: নদীমোহানায় সমুদ্রজলের ঘনত্ব যত বেশি হওয়ার জন্য সেখানে অতিদ্রুত পলি থিতিয়ে পড়ে। তাই দ্রুত বদ্বীপ গড়ে ওঠে।
সমুদ্রের উন্মুক্ততা: স্থলবেষ্টিত সমুদ্রে বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। কারণ এখানে সমুদ্রস্রোতের প্রভাব কম থাকে।
সমুদ্রজলের লবণতা : সমুদ্রজলের লবণতা বাড়লে মোহানায় নদীজলের পলিরাশি দ্রুত অধঃক্ষিপ্ত হয় | এতে বদ্বীপ গঠনের হার বাড়ে।
অন্যান্য: এ ছাড়া নদী ধীরে ধীরে সমুদ্রে পড়লে, মোহানা অঞ্চলটি
স্থিতিশীল হলে নদীর মুখে চর সৃষ্টি হলে দ্রুত বদ্বীপ গড়ে উঠতে পারে।
4. হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।
• উত্তর : হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ হিমবাহের ক্ষয়কার্য শুধুমাত্র উঁচু পর্বতের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে এবং এই ক্ষয়কার্যের ফলে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, যেমন—
করি বা সার্ক: হিমবাহের অবঘর্ষ ও উৎপাটন প্রক্রিয়ায় উঁচু পর্বতগাত্রে হাতল-যুক্ত ডেকচেয়ার বা গ্রিক দেশের অ্যাম্ফিথিয়েটার বা বড়ো চামচের আকৃতির যে ভূমিরূপ গঠিত হয়, তাকে স্কটল্যান্ডে করি এবং ফ্রান্সে সার্ক বলা হয়। একটি করির তিনটি অংশ দেখা যায়—[i] পিছনদিকে একটি খাড়া দেওয়াল, [ii] মধ্যভাগে একটি অর্ধবৃত্তাকার গর্ত এবং
[iii] নিম্নদিকে উটের কুব্জের মতো একটি অংশ। হিমবাহ-গলা জল
করি-তে জমে হ্রদ সৃষ্টি হলে, তাকে বলা হয় করি বা টার্ন হ্রদ,
উদাহরণ—হিমালয়, আল্পস প্রভৃতি হিমবাহ অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে এই প্রকার ভূমিরূপ দেখা যায় |
অ্যারেট বা এরিটি : হিমবাহের উৎসমুখী ক্ষয়ের ফলে একই পর্বতশৃঙ্গের দুই দিকে দুটি করির সৃষ্টি হলে ও তাদের আয়তন ক্রমশ
বৃদ্ধি পেতে থাকলে মধ্যবর্তী সংকীর্ণ খাড়া শিরা বা তীক্ষ্ম ফলকের মতো অংশকে বলা হয় অ্যারেট বা এরিটি। হিমালয় এবং কারাকোরাম পর্বতে অনেক এরিটি দেখা যায়।
পিরামিড চূড়া : একটি পর্বতের বিভিন্ন দিকে পাশাপাশি তিন-চারটি বিপরীতমুখী ‘করি’-র সৃষ্টি হলে সেগুলি ক্রমাগত মস্তকদেশের দিকে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে একটি পিরামিডের মতো আকৃতির চূড়া গঠন করে। এজন্য এর নাম পিরামিড চূড়া বা হর্ন। আল্পস পর্বতের ম্যাটারহর্ন এরকম একটি বিখ্যাত পিরামিড চূড়া | গঙ্গোত্রীর কাছে নীলকণ্ঠ শৃঙ্গও পিরামিড চূড়ার নিদর্শন।
ঝুলন্ত উপত্যকা : অনেক সময় পার্বত্য অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিসম্পন্ন হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে গঠিত গভীর প্রধান হিমবাহ
উপত্যকায় দুই পাশ থেকে অনেক কম শক্তিসম্পন্ন অগভীর ছোটো
ছোটো হিমদ্রোণি এসে মেশে। এক্ষেত্রে মনে হয় যেন উপ-হিমবাহ
উপত্যকা প্রধান হিমবাহ উপত্যকার ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় আছে।
এইভাবে ঝুলে থাকা উপ-হিমবাহ-উপত্যকাকে বলা হয় ঝুলন্ত উপত্যকা। এই উপত্যকা বরাবর নদী প্রবাহিত হলে সেখানে জলপ্রপ্রাতের সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ—হিমালয় পর্বতে বদ্রীনাথের নিকট মানা গ্রামের কাছে এরূপ ঝুলন্ত উপত্যকা দেখা যায় |
U-আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণি: হিমবাহ পার্বত্য অঞ্চলে সার্ক বা করির নীচের দিকে ক্রমশ যে প্রশস্ত উপত্যকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়, সেখানে হিমবাহের পার্শ্বক্ষয় ও নিম্নক্ষয় প্রায় সমানভাবে হয় বলে সেই উপত্যকাটির আকৃতি ইংরেজি ‘U’ অক্ষরের মতো হয়। একে তাই U- আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণি বলা হয়। এই জাতীয় উপত্যকায় ছোটো ছোটো হ্রদ দেখা যায় | এগুলির নাম প্যাটারনস্টার হ্রদ | হিমদ্রোণির নিম্নদিকে হিমসিঁড়ি বা হিমসোপান দেখা যায়।
ক্র্যাগ অ্যান্ড টেল: হিমবাহের গতিপথে কঠিন ও কোমল শিলা পরপর থাকলে কঠিন শিলা কোমল শিলাকে হিমবাহের ক্ষয়কার্য থেক কিছুটা রক্ষা করে। কোমল শিলা গঠিত অংশ তখন কঠিন শিলার পিছনে লেজের মতো বিস্তৃত থাকে, একে বলা হয় 'ক্র্যাগ অ্যান্ড টেল |
রসে মতানে: হিমবাহের প্রবাহপথে ঢিপির মতো আকৃতির শিলাখন্ড
থাকলে ওই শিলাখণ্ডটির যে দিক থেকে হিমবাহ আসে সেই দিকে অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় শিলাখণ্ডটি মসৃণ এবং বিপরীত দিকে উৎপাটন প্রক্রিয়ায় এবড়োখেবড়ো বা অসমৃণ হয় | এই ধরনের ঢিপির নাম রসে মতানে |
ফিয়র্ড: মেরু অঞ্চলের নিকট সমুদ্রপৃষ্ঠে গঠিত হিমবাহ উপত্যকা জলমগ্ন হয়ে যে সংকীর্ণ ও দীর্ঘ কিন্তু খাড়া পার্শ্বদেশবিশিষ্ট গভীর খাঁড়ির সৃষ্টি করে, তাকে ফিয়র্ড বলে | কম দীর্ঘ ও কম গভীর, কিন্তু প্রশস্ত হিমবাহ উপত্যকা জলমগ্ন হয়ে ফিয়ার্ড (fiard) গঠন করে। ফিয়র্ড নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডে দেখতে পাওয়া যায় |
হোয়েলব্যাক: হিমবাহের ক্ষয়ের ফলে হিমবাহের প্রবাহপথে অবস্থিত কোনো সমসত্ত্ব শিলার দুই দিক মসৃণ হয়ে যে খাড়া ঢালবিশিষ্ট ঢিপির সৃষ্টি হয়, তাকে হোয়েলব্যাক বা তিমি-পৃষ্ঠ ভূভাগ বলে।
কর্তিত স্পার বা শৈলশিরা : পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার
সময় হিমবাহের প্রবাহপথে যেসব স্পার বা পর্বতের অভিক্ষিপ্তাংশ (অর্থাৎ পর্বতের পাদদেশের প্রসারিত অংশ) পথ রোধ করে থাকে সেগুলিকে কেটে বা ক্ষয় করে হিমবাহ সোজা প্রবাহিত হয়। তাই এদের নাম কর্তিত স্পার বা শৈলশিরা | এগুলি দেখতে কিছুটা ত্রিভুজের মতো হয়।
দশম শ্রেণির ভূগোলের প্রথম অধ্যায়ের বড় কোশ্চেন|মাধ্যমিক ভূগোল ধারণা 5 নং প্রশ্ন উত্তর | মাধ্যমিক ভূগোল প্রথম অধ্যায় LAQ প্রশ্ন ও উত্তর
5. হিমবাহের সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।
হিমবাহের সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ
হিমবাহের সঞ্চয়কার্যকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় | যেমন—
পর্বতের উপরিভাগে সঞ্চয়
[i] গ্রাবরেখা: পার্বত্য হিমবাহের সঙ্গে বাহিত তীক্ষ্ণ, কোণাকার ও
অবাছাই প্রস্তরখণ্ড, কাদা ও অন্যান্য পদার্থ ধীরে ধীরে হিমবাহের
নীচে, দুই পাশে ও সামনে একটু একটু করে জমা হতে থাকে,
সেগুলিকে বলা হয় মোরেন বা গ্রাবরেখা। এর মধ্যে হিমবাহের
প্রবাহপথের দুপাশে গ্রাবরেখা সঞ্চিত হলে, তাকে বলে পার্শ্ব গ্রাবরেখা
এবং শেষপ্রান্তে সঞ্চিত হলে, তাকে বলে প্রান্ত গ্রাবরেখা | আর দুটি
হিমবাহ পাশাপাশি মিলিত হলে মাঝখানে সৃষ্টি হয় মধ্য গ্রাবরেখা।
[ii] আগামুক: হিমবাহের সঙ্গে বাহিত হয়ে শত শত কিমি দূরে সঞ্চিত বিশালাকৃতির শিলাখণ্ডকে ইরাটিক বলে | কানাডার অ্যালবার্টা প্রদেশে ইরাটিক দেখা যায়। পার্শ্ব গ্রাবরেখা মধ্য গ্রাবরেখা পর্বতের পাদদেশে সঞ্চয় বা হিমবাহ ও জলধারার মিলিত কাজের ফলে গঠিত
ভূমিরূপ: পর্বতের পাদদেশে হিমবাহের প্রান্তসীমায় (অর্থাৎ হিমরেখার নীচে) হিমবাহ ও হিমবাহ-গলিত জলধারা মিলিতভাবে কিছু ভূমিরূপ গঠন করে। যেমন—
–
[i] বহিঃধৌত সমভূমি: প্রান্ত গ্রাবরেখার শেষে যেখানে নদীর উৎপত্তি হয়, সেখান থেকে বরফগলা জলপ্রবাহের মাধ্যমে হিমবাহবাহিত নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সঞ্চিত হলে যে সমভূমির সৃষ্টি হয়, সেই সমভূমিটিকে বলা হয় বহিঃধৌত সমভূমি বা আউট-ওয়াশ প্লেন।
[ii] ড্রামলিন: বহিঃধৌত সমভূমির কাছে বা ওপরে হিমবাহ ও জলধারা বাহিত শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি উঁচু হয়ে সঞ্চিত হয়ে উলটানো নৌকা বা উলটানো চামচের মতো ভূমিরূপ গঠন করে,
তখন তাকে ড্রামলিন বলে। কোনো স্থানে পাশাপাশি অনেকগুলি
ড্রামলিন থাকলে তাকে ডিমের ঝুড়ি ভরতি ভূমিরূপ (Basket of
egg topography) বলা হয় | ড্রামলিনের হিমবাহের প্রবাহের দিক
অমসৃণ ও খাড়াই এবং বিপরীত দিক মসৃণ ও ঢালু হয়। এগুলির
উচ্চতা 6 মি. থেকে 60 মি. পর্যন্ত হয়
[iii] কেম: হিমবাহের শেষপ্রান্তে হিমবাহবাহিত বালি, কাদা, কাকর
প্রভৃতি পদার্থকে যখন হিমবাহ-গলিত জলধারা বহন করে নিয়ে গিয়ে কোনো বড়ো জলাভূমি বা হ্রদে সঞ্চয় করে ত্রিকোণাকার বা
বদ্বীপের মতো ভূমিরূপ গড়ে তোলে তখন তাকে কেম বলে | সিঁড়ির ধাপের মত গঠিত কেম-কে ‘কেম সোপান' বলা হয়।
[iv] এসকার: হিমবাহের তলদেশে অথবা হিমবাহের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত জলধারাবাহিত স্তরায়িত বালি, নুড়ি প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে শৈলশিরার মত দীর্ঘ ও আঁকাবাঁকা ভূমিরূপ গঠন করে। একে এসকার বলে। এগুলি দৈর্ঘ্যে কয়েক কিলোমিটার হলেও উচ্চতায় 3 থেকে 5 মিটার হয়।
[v] কেট্ল: কোনো কোনো সময় বহিঃধৌত সমভূমিতে বিরাট বিরাট
বরফের চাঁই নানা ধরনের অবক্ষেপের মধ্যে চাপা পড়ে থাকে। পরে
যখন ওই বরফ গলে যায়, তখন সেখানে বেশ বড়ো গর্তের সৃষ্টি হয়।
এর নাম কেটল। পরবর্তীকালে ওইসব গর্তে হিমবাহ-গলিত জল
জমে যে হ্রদের সৃষ্টি হয় তাকে বলে কেট্ল হ্রদ | স্কটল্যান্ডের উত্তরে ওকনি দ্বীপে কে এবং কেট্ল হ্রদ আছে।
[vi] নব: হিমবাহবাহিত ক্ষয়জাত পদার্থ হিমবাহ-গলিত জলধারার
মাধ্যমে বহিঃধৌত সমভূমির ওপর টিলার আকারে সঞ্চিত হলে সেই টিলাগুলিকে বলে নব
6. শুষ্ক অঞ্চলে বায়ু ও জলধারার মিলিত কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের চিত্রসহ বিবরণ দাও। [মাধ্যমিক '17]
• উত্তর: বায়ু ও জলাধারের মিলিত কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
মরুভূমি অঞ্চলে বৃষ্টিপাত খুব কম হয়। তবে যখন বৃষ্টিপাত হয়, একেবারে মুষলধারেই তার আবির্ভাব ঘটে। আর বৃষ্টিপাতের সেই জল ভূপৃষ্ঠের ঢাল বরাবর নেমে কিছু অনিত্যবহ জলধারাও সৃষ্টি করে। এজন্য মরু অঞ্চলে বায়ু ও জলধারার মিলিত কার্যের ফলে কিছু ভূমিরূপ সৃষ্টি হয় | যেমন—
ওয়াদি: আরবি শব্দ ‘ওয়াদি’-র অর্থ শুষ্ক উপত্যকা | মরু অঞ্চলের বালি ঢাকা ভূমিতে জল নিকাশের জন্য নদীনালা বিশেষ থাকে না বলে এক পশলা মুষলধারে বৃষ্টি হলেই বন্যা হয়ে যায়। বন্যা বা বৃষ্টির জল
বেরোনোর জন্য তখন বালুকাভূমির ওপর অস্থায়ী নদী সৃষ্টি হয় | জল নেমে গেলে ওগুলি শুষ্ক খাত হিসেবে পড়ে থাকে | এদেরই বলে ওয়াদি |
পেডিমেন্ট: বায়ুপ্রবাহ ও জলধারার মিলিত ক্ষয়কার্যে উচ্চভূমি বা
ইনসেলবার্ডের পাদদেশে যে প্রায়-সমতল বা মৃদু ঢালবিশিষ্ভূ মিভাগের সৃষ্টি হয় তাকে বলে পেডিমেন্ট। এর ঢাল গড়ে 1 (এক) থেকে 10°-এর মধ্যে থাকে। পেডিমেন্টের ওপর ছোটো ছোটো শিলাখণ্ড, ফাটল, পলি ইত্যাদি থাকতে পারে। অথবা পেডিমেন্ট সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হতে পারে।
বাজাদা : পেডিমেন্টের ওপর দিয়ে প্রবাহিত জলধারার সঙ্গে আসা নুড়ি, কাকর, পলি, বালি প্রভৃতি ঢালের নিম্নাংশে অর্থাৎ পেডিমেন্টের
পাদদেশে সঞ্চিত হয়ে ত্রিকোণাকার পললব্যজনী সৃষ্টি করে। এই ধরনের অনেকগুলি ভূমি পরস্পর যুক্ত হলে যে বড়ো আকারের পলল ভূমি গঠিত হয় তাকে বলে বাজাদা বা বাহাদা| সুতরাং পেডিমেন্টের সামনে গড়ে-ওঠা বাজাদা সম্পূর্ণরূপে সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ| পেডিমেন্টের দিকে বাজাদার খাড়া অবতল ঢাল সৃষ্টি হলেও প্লায়ার কাছে ঢাল খুব কম বা একেবারে শূন্যও হতে পারে।
প্পায়া : চারপাশের উচ্চভূমি থেকে আসা অনেকগুলি জলধারা
মধ্যভাগের উপত্যকা বা নিম্নভূমিতে মিলিত হলে সেখানে লবণাক্ত জলের অগভীর হ্রদ সৃষ্টি হয় | বাজাদা পৃষ্ঠের ওপর গড়ে ওঠা এই মরু হ্রদের নাম প্লায়া। এগুলি সাধারণত অস্থায়ী প্রকৃতির হয় এবং এদের আয়তন বা ক্ষেত্রমান কয়েক বর্গমিটার থেকে কয়েক বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে | মরু অঞ্চলে ক্ষয়কার্যের নিম্নসীমা বা শেষসীমা হল এই প্লায়া
7. মরু অঞ্চলের প্রসারণ কীভাবে ঘটছে? কীভাবে এর প্রতিকার করা সম্ভব?
• উত্তর : মরুভূমির প্রসারণের কারণ
পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সাথে পৃথিবীর মরুভূমিরও সম্প্রসারণ ঘটছে। ভারতের থর, আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির আয়তনও ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
অধিক পশুচারণ : স্বল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত মরুভূমির কোনো কোনো জায়গায ঘাস জন্মায়। সেজন্য মরুভূমির মানুষের প্রধান জীবিকা পশুপালন | পশুচারণের জন্য পশুর পায়ের চাপে মাটির ওপরের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় | বৃষ্টিপাত এবং বায়ুপ্রবাহ ওই সব বালি, মাটিকে উড়িয়ে নিয়ে যায় এবং অন্যত্র জমা করে।
বনধ্বংস: গাছের শিকড় মাটিকে আটকে রাখে। আবার গাছ বাতাস চলাচলে বাধা দেয়| বৃষ্টির জল সরাসরি মাটিতে না পড়ে গাছে পড়লে
মাটির ক্ষয় কম হয় | কিন্তু মরুভূমিতে যত গাছ কাটা চলবে ততই মরুভূমি এগোতে থাকবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি : পৃথিবীর সর্বত্র জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে | মরু অঞ্চলেও মানুষের সংখ্যা বাড়লে চাষবাস, পশুচারণ, পানীয় জল সংগ্রহ ও অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ বাড়বে। এতে মরু সম্প্রসারণও বাড়বে।
খাদ্যশস্যের উৎপাদন: অতিরিক্ত চাষবাসে জমির উর্বরতা কমে যায় ও ভূমিক্ষয় বাড়ে। বারবার লাঙল দিয়ে চাষ করার জন্য মাটি ঝুরঝুরে হয়ে যায় ও মরুকরণ ঘটে।
জ্বালানি কাঠ : মরুভূমির বেশিরভাগ মানুষ জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করে। তাই তারা মরু উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল | যত বেশি গাছ কাটা হবে, তত মরুভূমির প্রসারণ ঘটবে। এ ছাড়া, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জলসেচ, জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন মরুভূমির প্রসারণে সহায়তা করেছে | বর্তমানে ভূপৃষ্ঠের প্রায় 40 শতাংশ স্থান শুকনো এবং কৃষিজমির প্রায় ৪০ শতাংশ ভূমি মরু এবং মরুপ্রায় হওয়ার অবস্থায় রয়েছে।
মরুভূমির অগ্রগমন প্রতিরোধ
মরুভূমির এগিয়ে আসাকে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব। মরুভূমির প্রসারণ রোধ করার উপায়গুলি হল—
বনভূমি তৈরি : মরুভূমির প্রান্ত বরাবর নিবিড়ভাবে বনভূমি গড়ে তুলতে হবে| গাছ মরু প্রসারণ রোধ করে | এমন উদ্ভিদ রোপণ করতে হবে যা মরু জলবায়ুর উপযুক্ত |
পশুচারণ রোধ: পশুচারণে মাটির ক্ষয় বাড়ে। তাই পশুচারণ বন্ধকরতে হবে।
জ্বালানির উৎস সন্ধান: কাঠকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। এর বদলে গোবরগ্যাস, ঘুটে, কেরোসিন, LPG ও অন্যান্য উৎস বা বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।
ভূমির সুস্থিত ব্যবহার : মরুভূমিতে মিশ্রকৃষির প্রসার, মাটিতে জৈব সারের ব্যবহার, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং আধুনিক জলসেচ পদ্ধতির প্রয়োগ, জৈব কৃষি, জলের সঠিক ব্যবহার, ওই জলবায়ুর উপযুক্ত ফসল নির্ধারণ ইত্যাদির মাধ্যমে মরুভূমির সম্প্রসারণ অনেকটাই আটকানো সম্ভব।
জল সংরক্ষণ : বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, জলধারণ, ভৌমজলের পরিমাণ বাড়ানো, জলের অপচয় কমানো, এমনকি জলের বহুমুখী ও
বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহার প্রভৃতি উপায় অবলম্বন করতে পারলে মরুভূমির প্রসার অনেকাংশে আটকানো সম্ভব।