1. দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলি কী ছিল?
উত্তর : ভারতে প্রাক্-স্বাধীনতাপর্বে দু-ধরনের রাজ্য ছিল, যথা ব্রিটিশশাসিত প্রদেশ এবং ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন দেশীয় রাজ্য। স্বাধীনতা লাভের পর বিভিন্ন সমস্যা অতিক্রম করে ভারত দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করেছিল।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলি ছিল—
[1] বিক্ষিপ্ত অবস্থান: দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এরকম বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে ভোপাল, হায়দ্রাবাদ, ত্রিবাঙ্কুরসহ বেশকিছু রাজ্য ভারতের সঙ্গে যোগদান না করে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এইভাবে স্বতন্ত্র দেশীয় রাজ্যগুলি ছড়িয়ে থাকলে তা ভারতের নিরাপত্তারক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যাজনক ছিল।
[12] জাতীয়তাবাদী আদর্শে বাধা: অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শ দ্বারা পরিচালিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দেশীয় রাজ্যগুলি স্বাধীন থাকার মনোভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেন ভারতের ভৌগোলিক সীমার যে, মধ্যে কোনো স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করা যাবে না।
[3] প্রজা বিদ্রোহের আশঙ্কা : দেশীয় রাজ্যগুলি রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক ও পশ্চাপদ ছিল। তাই এই রাজ্যগুলির প্রজারা গণতান্ত্রিক ও উন্নত ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে উৎসুক ছিল। কিন্তু এই রাজ্য গুলির শাসকরা স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল।
বিশেষ সমস্যা: ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হায়দ্রাবাদ ও জুনাগড় ছাড়া অন্যান্য রাজ্যগুলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন জটিলতার কারণে সমগ্র কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে ভারত সরকার ব্যর্থ হয়। এই কাশ্মীর সমস্যা আজও বর্তমান ।
উপসংহার: উপরোক্ত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কূটনীতি ও শক্তি প্রয়োগ কর দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করে।
2. উদ্বাস্তু সমস্যার ক্ষেত্রে পাঞ্জাব ও বাংলার পার্থক্যগুলি কী ছিল তা বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজন এবং একইসঙ্গে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাজনের ঘটনা ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার সূচনা করেছিল। ভারত সরকারের কাছে উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল এক বড়ো সমস্যা | পাঞ্জাব বিভাজনের সঙ্গে বাংলা বিভাজনের বেশিকিছু মিল থাকলেও পার্থক্য ছিল বেশি, যেমন—
[1] জনহস্তান্তর: পাঞ্জাব বিভাজনের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের মধ্যে জনহস্তান্তর ও সম্পত্তির বিনিময় করা হলেও বাংলার ক্ষেত্রে তা হয়নি।
[2] আগমন: পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটেছিল দু-বছর ধরে। কিন্তু বাংলায় তা ছিল ধারাবাহিক।
[3] আশ্রয়স্থান: ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের স্রোত ছিল পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গমুখী। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা উদ্বাস্তুরা পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয় | অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা কলকাতা ও কলকাতা সন্নিহিত চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেয়।
[4] ভাষাগত সমস্যা : পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের ভাষাগত সমস্যা না থাকার কারণে পাঞ্জাবি ও সিন্ধুি উদ্বাস্তুরা দিল্লি, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারলেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাংলাভাষী উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম ছাড়া অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেনি।
উপসংহার: উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও পার্থক্য লক্ষ করা যায়—জওহরলাল নেহরু বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যা অপেক্ষা পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু পুনর্বাসনকে অধিক গুরুত্ব দেন। তাঁর কথায় পূর্ব
পাকিস্তানের হিন্দু উদ্বাস্তুদের পশ্চিম মুখে যাত্রার মূল কারণ ছিল নিছক কাল্পনিক ভয়।
প্রশ্ন 3. ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কীভাবে সম্পন্ন হয়েছিল তা আলোচনা করো।
উত্তর : ভারতে রাজ্যগুলির সীমানা কী হবে অথবা রাজ্যগুলি ভাষাভিত্তিক বা উপজাতিভিত্তিক হবে কি না সে
সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দেয়। স্বাধীন তেলুগু ভাষাভিত্তিক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠন এই বিতর্কে ইন্ধন যোগায় |
[1] ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন: ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও আইনের ভিত্তিতে ১৬টি প্রদেশ ও ৩টি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য গঠনের কথা বলা হয়। এই আইনের ভিত্তিতে—[i] হায়দ্রাবাদ থেকে তেলেঙ্গানাকে বিচ্ছিন্ন করে অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। [ii] মালাবার ও ত্রিবাঙ্কুর কোচিনকে যুক্ত করে গঠন করা হয় কেরল। [iii] কন্নড়ভাষী অঞ্চলগুলিকে মহীশূরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। [iv] কচ্ছ, সৌরাষ্ট্র ও হায়দ্রাবাদের মারাঠিভাষী অঞ্চলের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় বৃহত্তর বম্বে প্রদেশ। এবং [v] বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কিছু অংশ ও পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
[2] প্রতিক্রিয়া: এভাবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠিত হলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিক্রিয়ার সূচনা এবং ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দাবি আরও জেরালো হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত—[i] ১৯৬০
খ্রিস্টাব্দে বম্বে প্রদেশকে দু-ভাগ করে মারাঠিভাষী মহারাষ্ট্র ও গুজরাটিভাষী গুজরাট রাজ্য তৈরি করা হয়। [ii] পাঞ্জাব প্রদেশকে ভেঙে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা নামক দুটি রাজ্য তৈরি করা হয় (১৯৬৬ খ্রি.)।
[3] গুরুত্ব : ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের ফলে কয়েকটি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গড়ে ওঠে, যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি । এর ফলে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী গুরুত্ব লাভ করে। তবে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন ভারতের জাতীয় সংহতির পক্ষে আপাত ক্ষতিকারক হলেও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিতে তা ক্ষতিকারক ছিল না।
উপসংহার: তাই ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন ছিল রাজ্য পুনর্গঠনের এক যুক্তিসংগত পদক্ষেপ | তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের বিষয়টি বেশকিছু জটিলতারও সৃষ্টি করেছিল।
4. কীভাবে দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তি- করণ করা হয়?
• উত্তর : স্বাধীনতা লাভের পর ভারত যেসব জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তিকরণ সমস্যা | স্বাধীনতার প্রাক্কালে এইসব দেশীয় রাজ্যগুলির সংখ্যা ছিল ৬১০টি।
[1] দেশীয় রাজ্য দপ্তর গঠন : এই রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে গঠিত হয় দেশীয় রাজ্য দপ্তর।
[2] গৃহীত নীতি : লৌহমানব রূপে পরিচিত সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের দৃঢ় মনোভাব, স্বরাষ্ট্রসচিব ভি পি মেননের কূটকৌশল এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সহযোগিতায় দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা সহজ ওঠে। দেশীয় রাজ্যগুলির হয়েএক্ষেত্রে সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতি গৃহীত হয়।
প্রথমত, নিকটবর্তী প্রদেশগুলির সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তিকরণের নীতি গৃহীত হয়। এই নীতি অনুসারে ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের দেশীয় রাজ্যগুলি, বম্বে-র সঙ্গে দাক্ষিণাত্য ও গুজরাটের দেশীয় রাজ্যগুলি, উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে রামপুর, বেনারস, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোচবিহার, আসামের সঙ্গে খাসি পার্বত্য অঞ্চল এবং মাদ্রাজের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশীয় রাজ্যগুলিকে সংযুক্ত করা হয়।
দ্বিতীয়ত, একাধিক ছোটো-বড়ো রাজ্যকে সংযুক্ত করে রাজস্থান, পাঞ্জাব, বিন্ধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি যুক্তরাজ্য গঠিত হয়।
তৃতীয়ত, হিমাচল প্রদেশ, কচ্ছ, বিলাসপুর, ভোপাল, ত্রিপুরা, মণিপুর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে আনা হয়।
চতুর্থত, দিল্লি-সহ একাধিক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করা হয়।
উপসংহার: ২১৬টি দেশীয় রাজ্য প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়। ২৭৫টি দেশীয় রাজ্ ৫টি পৃথক প্রদেশে পরিণত হয় এবং ৬১টি দেশীয় রাজ্যকে ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সাথে যুক্ত করা হয়। এইভাবে দেশীয় রাজ্য সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে স্বাধীন ভারতের অভ্যন্তরীণ অখণ্ডতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। কথোপকথন বা লেখনীর মাধ্যমে স্মৃতিকথায় দেশভাগের ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়, যেমন—
[1] দেশের স্মৃতি : উদ্বাস্তুদের অনেকেই তাদের পূর্ববর্তী দেশ বা মাতৃভূমির স্মৃতিচারণ করে থাকে। এই স্মৃতির মধ্যে দিয়ে তাদের ফেলে আসা ঘরবাড়ি, জমিজায়গা, পরিবেশ, বন্ধুবান্ধব, খাওয়া-দাওয়া প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্য প্রতিফলিত হয়।
6. স্মৃতিকথায় দেশভাগ কীভাবে দেশভাগ সম্পর্কিত ইতিহাসচর্চায় নতুন উপাদান সরবরাহ করেছে তা বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : দেশভাগ-সম্পর্কিত ইতিহাসচর্চায় সরকারি নথিপত্রের পাশাপাশি ১৯৭০-এর দশক থেকে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাকেও গুরুত্বপূর্ণ উপাদানরূপে ব্যবহার করা শুরু হয় | বর্তমানের প্রেক্ষিতে অতীতের ঘটনাগুলি মনে করাই হল স্মৃতি। তাই দেশভাগের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা উদ্বাস্তু বা প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিকথার ভিত্তিতে এই সম্পর্কিত অনেক অজানা ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়েছে ।
[2] দেশভাগের স্মৃতি : লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত- বিভাজন, স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের বঙ্গ ও পাঞ্জাব সীমান্ত নির্ধারণের সময় থেকেই পূর্ববঙ্গের হিন্দু ও ঘ। পশ্চিম পাঞ্জাবের শিখদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। স্মৃতিকথায় এই আতঙ্কের প্রতিফলন পাওয়া যায়।
[3] দেশ পরিত্যাগের স্মৃতি: স্মৃতিকথার মধ্যে দিয়ে হিংসা ও অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসা উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা বা এদেশে জমি- জমা কিনে ছিন্নমূল মানুষদের নতুনভাবে বসবাস শুরুর কথা বা জীবন সংগ্রামের কথা জানা যায় |
[4] ত্রাণ ও পুনর্বাসনের স্মৃতি : ভারত সরকার কর্তৃক উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বাংলা অপেক্ষা দিল্লিই অগ্রাধিকার পেয়েছিল। বাংলার উদ্বাস্তুদের জন্য যে ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল তা কলকাতারনিকটবর্তী স্থানে ছিল না। এই ক্যাম্পগুলিতে পানীয় জল ও শৌচাগারের সমস্যার কথা, কলহ ও পুলিশি অত্যাচার প্রভৃতি বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।
উপসংহার: স্মৃতিকথা নির্ভর ইতিহাস সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয় | তবে দেশভাগের ফলে যেহেতু বিশাল সংখ্যক শিখ ও হিন্দুদের উদ্বাস্তুরূপে ভারতে আসতে হয়েছিল সেক্ষেত্রে অনেকের স্মৃতির ভিত্তিতে একটি সাধারণ ইতিহাস রচনা করা যেতেই পারে।
7. উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের স্রোত ছিল পূর্ব ওপশ্চিমবঙ্গমুখী। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা উদ্বাস্তুরা পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান ও
উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয় | অন্যদিকে, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা কলকাতা ও কলকাতা-সন্নিহিত চবিবশ পরগনা, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেয়।
উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়, যথা—
[1] পুনর্বাসন নীতি: ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উদ্বাস্তু সমস্যার ব্যাপকতা উপলব্ধি করেন এবং এই ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের নীতির ওপর গুরুত্ব দেন। তাই স্বাধীনতার প্রথম পাঁচ বছর পুনর্বাসনের যুগ নামে পরিচিতি।
[2] উদ্বাস্তু শিবির : উদ্বাস্তুদের বাসস্থান, আহার ও নিরাপত্তাদানের জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর সংখ্যক অস্থায়ী বাসস্থান বা শিবির তৈরি করা হয় | এই শিবিরগুলিতে নথিভুক্ত উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব ও সরকারি সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।
[3] সরকারি সাহায্য: গ্রামাঞ্চলে উদ্বাস্তুদের
জমিদান, কৃষিঋণ ও গৃহনির্মাণে ভরতুকি বা সরকারি
সাহায্য দেওয়া হয়। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে সরকার উদ্বাস্তুদের জন্য শিল্প ও কারিগরি শিক্ষাপ্রদান ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
[4] দিল্লি চুক্তি: ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে যৌথচুক্তিতে আবদ্ধ হন, যা নেহরু-
লিয়াকত চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে বলা হয় যে, সংখ্যালঘুরা যে যার রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে এবং তার সেই দেশের কাছেই নিজেদের সমস্যার সমাধান চাইবে। ভবিষ্যতে দাঙ্গা প্রতিহতকরণের ব্যবস্থা করা হবে এবং উদ্বাস্তুদেরনিজের দেশে প্রত্যাবর্তনে উৎসাহদান করা হবে।
উপসংহার: উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও তা ছিল মূলত দিল্লি ও পূর্ব পাঞ্জাব নির্ভর। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যা অবহেলিত হয়েছিল। তা ছাড়া উদ্বাস্তু শিবিরগুলি ছিল শহর অধিকাংশক্ষেত্রেই সেখানে পানীয় জল, শৌচালয় বা থেকে দূরে এবং ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিসেবাও ছিল না।
8. রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন (১৯৫৩ খ্রি.) সম্পর্কে কী জান?
● উত্তর
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন
ভূমিকা: স্বাধীন ভারতে কোন্ নীতি অনুসারে অঙ্গরাজ্যগুলির সীমানা চিহ্নিত করা উচিত সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ (SRC) গঠন করেন।
[1] সদস্য: তিনজন সদস্য নিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের সভাপতি ছিলেন বিচারপতি ফজল আলি। কমিশনের অপর দুজন সদস্য ছিলেন কে এম পানিক্কর ও হৃদয়নাথ কুঞ্জরু।
[2] সুপারিশ: রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তার প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের সুপারিশ করা হয়।
[3] রাজ্য পুনর্গঠন আইন: রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ভারতীয় আইনসভায় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘রাজ্য পুনর্গঠন আইন' পাস হয়। এই আইন অনুসারে ওই বছর ১ নভেম্বর ভাষাভিত্তিক ১৪টি রাজ্য এবং ৬টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।
[4] বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল : ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে যে ১৪টি ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠিত হয় সেগুলি হল অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম, উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ, কেরালা, জম্মু ও কাশ্মীর, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, বিহার বোম্বাই, মধ্যপ্রদেশ, মহীশূর, মাদ্রাজ ও রাজস্থান এবং যে ৬টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয় সেগুলি হল ত্রিপুরা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, দিল্লি, লাক্ষাদ্বীপ, মণিপুর ও হিমাচল প্রদেশ।
10. ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের সরকারি ভাষা আইন সম্পর্কে কী জান?
● উত্তর
সরকারি ভাষা আইন (১৯৬৩ খ্রি.)
ভূমিকা: ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত সরকারি ভাষা কমিশন তার প্রতিবেদনে (১৯৫৬ খ্রি.) দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত হিন্দিকে ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে।
[1] আইন পাস : সরকারি ভাষা কমিশন হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অ- হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। দক্ষিণ ভারতে হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু হয়। এই অবস্থায় ভারতীয় পার্লামেন্টে সরকারি ভাষা আইন (১৯৬৩ খ্রি.) পাস হয়।
[2] অহিনের ধারা : সরকারি ভাষা আইন অনুসারে—
i. ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের পরও সরকারি কাজকর্মে হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার ব্যবহারও চালু থাকে।
ii. রাজ্য বিধানসভাগুলি নিজ নিজ রাজ্যের জন্য সরকারি ভাষা নির্দিষ্ট করার অধিকার পায়।
[3] অষ্টম তফসিল: সরকারি ভাষা আইনের ধারা অনুসারে বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভা তাদের সরকারি ভাষা নির্দিষ্ট করলে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে সরকারি ভাষা হিসেবে ১৪টি ভাষা স্থান পায়। এই ভাষাগুলি হল—অসমিয়া, বাংলা, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মীরি, মালয়ালম, মারাঠি, উড়িয়া পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, তামিল, তেলুগু এবং উর্দু।