বহুরূপী - সুবোধ ঘোষ | দশম শ্রেণীর বাংলা গল্প বহুরূপী
আজকের এই পোষ্টের মাধ্যমে আমি দশম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্য বইয়ের অন্তর্গত বহুরূপী গল্পটি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব। গল্পের নাম: বহুরূপী, গল্পের লেখক : সুবোধ ঘোষ | আজকে আমিদশম শ্রেণীর বহুরূপী গল্পটি সম্পূর্ণ আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করেছি এবং এই বহুরূপী গল্প সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর গুলো আমি আমাদের পরবর্তী পোস্টে দিয়ে দেব | এই পোস্টের নিচের লিংক দেওয়া থাকবে সেখান থেকে গিয়ে দশম শ্রেণীর বাংলা গল্প বহুরূপী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর দেখে নিতে পারবেন। bahurupi subodh ghosh
বহুরূপী - সুবোধ ঘোষ |
বহুরূপীসুবোধ ঘোষ
হরিদার কাছে আমরাই গল্প করে বললাম, শুনেছেন, হরিদা, কী কাণ্ড হয়েছে?
উনানের মুখে ফুঁ দিয়ে আর অনেক ধোঁয়া উড়িয়ে নিয়ে হরিদা এইবার আমাদের কথার জবাব দিলেন – না, কিছুই শুনিনি।
— জগদীশবাবু যে কী কাণ্ড করেছেন, শোনেননি হরিদা?
হরিদা - না রে ভাই, বড়ো মানুষের কাণ্ডের খবর আমি কেমন করে শুনব? আমাকে বলবেই বা কে?
—সাতদিন হলো এক সন্ন্যাসী এসে জগদীশবাবুর বাড়িতে ছিলেন। খুব উঁচু দরের সন্ন্যাসী। হিমালয়ের গুহাতে থাকেন। সারা বছরে শুধু একটি হরীতকী খান; এ ছাড়া আর কিছুই খান না। সন্ন্যাসীর বয়সও হাজার বছরের বেশি বলে অনেকেই মনে করেন।
হরিদা—সন্ন্যাসী কি এখনও আছেন?
—না, চলে গিয়েছেন। আক্ষেপ করেন হরিদা— থাকলে একবার গিয়ে পায়ের ধুলো নিতাম।
— তা পেতেন না হরিদা ! সে ভয়ানক দুর্লভ জিনিস। শুধু ওই একা জগদীশবাবু ছাড়া আর কাউকে পায়ের ধুলো নিতে দেননি সন্ন্যাসী। হরিদা কেন?
- জগদীশবাবু একজোড়া কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে ধরলেন। তখন বাধ্য হয়ে সন্ন্যাসী পা এগিয়ে দিলেন, নতুন খড়ম পরলেন আর সেই ফাঁকে জগদীশবাবু পায়ের ধুলো নিয়েছিলেন।
হরিদা বাঃ, এ তো বেশ মজার ব্যাপার!
হ্যাঁ, তা ছাড়া সন্ন্যাসীকে বিদায় দেবার সময় জগদীশবাবু একশো টাকার একটা নোট জোর করে সন্ন্যাসীর ঝোলার ভেতরে ফেলে দিলেন। সন্ন্যাসী হাসলেন আর চলে গেলেন। গল্প শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন হরিদা। অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমরা কী বলছি বা না বলছি, সেদিকে হরিদার যেন কান নেই।
হরিদার উনানের আগুন তখন বেশ গনগনে হয়ে জ্বলছে। আমাদের চায়ের জন্য এক হাঁড়ি ফুটন্ত জল নামিয়ে দিয়েই হরিদা তাঁর ভাতের হাঁড়িটাকে উনানে চড়ালেন।
শহরের সবচেয়ে সরু এই গলিটার ভিতরে এই ছোট্ট ঘরটাই হরিদার জীবনের ঘর; আর আমাদের চারজনের সকাল-সন্ধ্যার আড্ডার ঘর। চা চিনি আর দুধ আমরাই নিয়ে আসি। হরিদা শুধু তাঁর উনানের আগুনের আঁচে জল ফুটিয়ে দেন।
খুবই গরিব মানুষ হরিদা। কিন্তু কাজ করতে হরিদার প্রাণের মধ্যেই যেন একটা বাধা আছে। ইচ্ছে করলে কোনো অফিসের কাজ, কিংবা কোনো দোকানের বিক্রিওয়ালার কাজ পেয়ে যেতে পারেন হরিদা; কিন্তু ওই ধরনের কাজ হরিদার জীবনের পছন্দই নয়। একেবারে ঘড়ির কাঁটার সামনে সময় বেঁধে দিয়ে আর নিয়ম করে নিয়ে রোজই একটা চাকরির কাজ করে যাওয়া হরিদার পক্ষে সম্ভব নয়। হরিদার উনানের হাঁড়িতে অনেক সময় শুধু জল ফোটে, ভাত ফোটে না। এই একঘেয়ে অভাবটাকে সহ্য করতে হরিদার আপত্তি নেই, কিন্তু একঘেয়ে কাজ করতে ভয়ানক আপত্তি।
হরিদার জীবনে সত্যিই একটা নাটকীয় বৈচিত্র্য আছে। আর, সেটাই যে হরিদার জীবনের পেশা। হরিদা মাঝে মাঝে বহুরূপী সেজে যেটুকু রোজগার করেন, তাতেই তাঁর ভাতের হাঁড়ির দাবি মিটিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে সত্যিই উপোস করেন হরিদা। তারপর একদিন হঠাৎ আবার এক সকালে কিংবা সন্ধ্যায় বিচিত্র ছদ্মবেশে অপরূপ হয়ে পথে বের হয়ে পড়েন। কেউ চিনতে পারে না। যারা চিনতে পারে এক-আনা দু-আনা বকশিশ দেয়।
যারা চিনতে পারে না, তারা হয় কিছুই দেয় না, কিংবা বিরক্ত হয়ে দুটো-একটা পয়সা দিয়ে দেয়। একদিন চকের বাস স্ট্যান্ডের কাছে ঠিক দুপুরবেলাতে একটা আতঙ্কের হল্লা বেজে উঠেছিল। একটা উন্মাদ পাগল; তার মুখ থেকে লালা ঝরে পড়ছে, চোখ দুটো কটকটে লাল। তার কোমরে একটা ছেঁড়া কম্বল জড়ানো, গলায় টিনের কৌটার একটা মালা। পাগলটা একটা থান ইট হাতে তুলে নিয়ে বাসের উপরে বসা যাত্রীদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠছে যাত্রীরা, দুটো একটা পয়সা ফেলেও দিচ্ছে।
একটু পরেই বাসের ড্রাইভার কাশীনাথ ধমক দেয়। —খুব হয়েছে হরি, এই বার সরে পড়ো। অন্যদিকে যাও।
অ্যাঁ? ওটা কি একটা বহুরূপী? বাসের যাত্রীরা কেউ হাসে, কেউ বা বেশ বিরক্ত হয়, কেউ আবার বেশ
বিস্মিত। সত্যিই, খুব চমৎকার পাগল সাজতে পেরেছে তো লোকটা।
হরিদার জীবন এইরকম বহু রূপের খেলা দেখিয়েই একরকম চলে যাচ্ছে। এই শহরের জীবনে মাঝে মাঝে বেশ চমৎকার ঘটনা সৃষ্টি করেন বহুরূপী হরিদা। সন্ধ্যার আলো সবেমাত্র জ্বলেছে, দোকানে দোকানে
লোকজনের ব্যস্ততা আর মুখরতাও জমে উঠেছে। হঠাৎ পথের উপর দিয়ে ঘুঙুরের মিষ্টি শব্দ রুমঝুম করে বেজে-বেজে চলে যেতে থাকে। এক রূপসি বাইজি প্রায় নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে। শহরে যারা নতুন এসেছে,
তারা দুই চোখ বড়ো করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু দোকানদার হেসে ফেলে - হরির কাণ্ড।
অ্যাঁ? এটা একটা বহুরূপী নাকি? কারও কারও মুগ্ধ চোখের মোহভঙ্গ হয়, আর যেন বেশ একটু হতাশস্বরে প্রশ্ন করে ওঠে।
বাইজির ছদ্মবেশে সেদিন হরিদার রোজগার মন্দ হয়নি। মোট আট টাকা দশ আনা পেয়েছিলেন। আমরাও দেখেছিলাম, এক-একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই রূপসি বাইজি, মুচকি হেসে আর চোখ টিপে একটা ফুলসাজি এগিয়ে দিচ্ছে। দোকানদারও হেসে ফেলে আর একটা সিকি তুলে নিয়ে বাইজির হাতের ফুলসাজির উপর ফেলে দেয়। কোনোদিন বাউল, কোনোদিন কাপালিক। কখনও বোঁচকা কাঁধে বুড়ো কাবুলিওয়ালা, কখনও হ্যাট-কোট-পেন্টলুন-পরা ফিরিঙ্গি কেরামিন সাহেব। একবার পুলিশ সেজে দয়ালবাবুর লিচু বাগানের ভিতরে
দাঁড়িয়েছিলেন হরিদা; স্কুলের চারটে ছেলেকে ধরেছিলেন। ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল ছেলেগুলো; আর স্কুলের মাস্টার এসে সেই নকল পুলিশের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন—এবারের মতো মাপ করে দিন ওদের। কিন্তু আটআনা ঘুষ নিয়ে তারপর মাস্টারের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন সেই নকল-পুলিশ হরিদা।
পরদিন অবশ্য স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের জানতে বাকি থাকেনি, কাকে তিনি আটআনা ঘুষ দিয়েছেন। কিন্তু মাস্টারমশাই একটুও রাগ করেননি। বরং একটু তারিফই করলেন—বা, সত্যি, খুব চমৎকার পুলিশ সেজেছিল হরি!
আজ এখন কিন্তু আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, হরিদা এত গম্ভীর হয়ে কী ভাবছেন। সন্ন্যাসীর গল্পটা শুনে কি হরিদার মাথার মধ্যে নতুন কোনো মতলব ছটফট করে উঠেছে?
ঠিকই, আমাদের সন্দেহ মিথ্যে নয়। হরিদা বললেন—আজ তোমাদের একটা জবর খেলা দেখাব।
—আমাদের দেখিয়ে আপনার লাভ কি হরিদা? আমাদের কাছ থেকে একটা সিগারেটের চেয়ে বেশি কিছু তো পাবেন না।
হরিদা—না, ঠিক তোমাদের দেখাব না। আমি বলছি তোমরা সেখানে থেকো। তাহলে দেখতে পাবে...। —কোথায়?
হরিদা—আজ সন্ধ্যায় জগদীশবাবুর বাড়িতে।
—হঠাৎ জগদীশবাবুর বাড়িতে খেলা দেখাবার জন্যে আপনার এত উৎসাহ জেগে উঠল কেন?
হরিদা হাসেন—মোটা মতন কিছু আদায় করে নেব। বুঝতেই তো পারছ, পুরো দিনটা রূপ ধরে ঘুরে বেড়িয়েও দু-তিন টাকার বেশি হয় না। একবার বাইজি সেজে অবিশ্যি কিছু বেশি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ওতেই বা কি হবে?
ঠিকই বলেছেন হরিদা। সপ্তাহে বড়োজোর একটা দিন বহুরূপী সেজে পথে বের হন হরিদা। কিন্তু তাতে সাতদিনের পেট চলবার মতো রোজগার হয় না।
হরিদা বলেন—নাঃ, এবার আর কাঙালের মতো হাত পেতে বকশিস নেওয়া নয়। এবার মারি তো গড়ার, লুটি তো ভাণ্ডার। একবারেই যা ঝেলে নেব তাতে আমার সারা বছর চলে যাবে।
কিন্তু সে কী করে সম্ভব? জগদীশবাবু ধনী মানুষ বটেন, কিন্তু বেশ কৃপণ মানুষ। হরিদাকে একটা যোগী সন্ন্যাসী কিংবা বৈরাগী সাজতে দেখে কত আর খুশি হবেন জগদীশবাবু? আর খুশি হলেই বা কত আনা বকশিশ দেবেন। পাঁচ আনার বেশি তো নয়।
হরিদা বলেন—তোমরা যদি দেখতে চাও, তবে আজ ঠিক সন্ধ্যাতে জগদীশবাবুর বাড়িতে থেকো।
আমরা বললাম—থাকব; আমাদের স্পোর্টের চাঁদা নেবার জন্যে আজ ঠিক সন্ধ্যাতেই জগদীশবাবুর কাছে যাব!
বড়ো চমৎকার আজকে এই সন্ধ্যার চেহারা। আমাদের শহরের গায়ে কতদিন তো চাঁদের আলো পড়েছে, কিন্তু কোনোদিন তো আজকের মতো এমন একটা স্নিগ্ধ ও শান্ত উজ্জ্বলতা কখনও চারদিকে এমন সুন্দর হয়ে ফুটে ওটেনি।
ফুরফুর করে বাতাস বইছে। জগদীশবাবুর বাড়ির বাগানের সব গাছের পাতাও ঝিরিঝিরি শব্দ করে কী যেন বলতে চাইছে। জগদীশবাবুর বাড়ির বারান্দাতে মস্ত বড়ো একটা আলো জ্বলছে। সেই আলোর কাছে একটা চেয়ারের উপর বসে আছেন জগদীশবাবু। সাদা মাথা, সাদা দাড়ি, সৌম্য শান্ত ও জ্ঞানী মানুষ জগদীশবাবু।
আমরা আমাদের স্পোর্টের চাঁদার খাতাটিকে জগদীশবাবুর হাতে তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
চমকে উঠলেন জগদীশবাবু। বারান্দার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে জগদীশবাবুর দুই বিস্মিত চোখ অপলক হয়ে গেল।
আমরাও চমকে উঠেছি বইকি। আশ্চর্য হয়েছি, একটু ভয়ও পেয়েছি। কারণ, সত্যিই যে বিশ্বাস করতে পারছি
না, সিঁড়ির কাছে এসে যে দাঁড়িয়েছে, সে কি সত্যিই হরিদা? ও চেহারা কি সত্যিই কোনো বহুরূপীর হতে পারে? জটাজুটধারী কোনো সন্ন্যাসী নয়। হাতে কমণ্ডলু নেই, চিমটে নেই। মৃগচর্মের আসনও সঙ্গে নেই। গৈরিক সাজও নেই।
আদুড় গা, তার উপর একটি ধবধবে সাদা উত্তরীয়। পরনে ছোটো বহরের একটি সাদা থান। মাথায় ফুরফুর করে উড়ছে শুকনো সাদা চুল। ধুলো মাখা পা, হাতে একটা ঝোলা, সে ঝোলার ভিতরে শুধু একটা বই, গীতা। গীতা বের করে কী-
-যেন দেখলেন এই আগন্তুক। তারপর নিজের মনেই হাসলেন।
আগন্তুক এই মানুষটি যেন এই জগতের সীমার ওপার থেকে হেঁটে হেঁটে চলে এসেছেন। শীর্ণ শরীরটাকে প্রায় অশরীরী একটা চেহারা বলে মনে হয়। কী অদ্ভুত উদাত্ত শান্ত ও উজ্জ্বল একটা দৃষ্টি এই আগন্তুকের চোখ থেকে ঝরে পড়ছে!
উঠে দাঁড়ালেন জগদীশবাবু—আসুন।
আগন্তুক হাসেন—আপনি কি ভগবানের চেয়েও বড়ো?
জগদীশবাবু কিছু ভেবে বলেন—কেন? কেন আপনি একথা কেন বলছেন মহারাজ?
আমি মহারাজ নই, আমি এই সৃষ্টির মধ্যে এককণা ধূলি। —কিন্তু আপনি বোধহয় এগারো লক্ষ টাকার সম্পত্তির অহংকারে নিজেকে ভগবানের চেয়েও বড়ো বলে মনে করেন। তাই ওখানেই দাঁড়িয়ে আছেন, নেমে আসতে পারছেন না।
সেই মূহূর্তে সিঁড়ি ধরে নেমে যান জগদীশবাবু। —আমার অপরাধ হয়েছে। আপনি রাগ করবেন না।
আগন্তুক আবার হাসেন—আমি বিরাগী, রাগ নামে কোনো রিপু আমার নেই। ছিল একদিন, সেটা পূর্বজন্মের কথা।
জগদীশবাবু—বলুন, এখন আপনাকে কীভাবে সেবা করব?
বিরাগী বলেন—ঠান্ডা জল চাই, আর কিছু চাই না।
ঠান্ডা জল খেয়ে নিয়ে হাঁপ ছাড়েন বিরাগী। এদিকে ভবতোষ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে। —না না, হরিদা নয়। হতেই পারে না। অসম্ভব! হরিদার গলার স্বর এরকমেরই নয়। বিরাগী বলেন—পরম সুখ কাকে বলে জানেন? সব সুখের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া!
ভবতোষের কানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে অনাদি বলে—শুনছো তো? এসব ভাষা কি হরিদার মুখের ভাষা হতে পারে?
জগদীশবাবু ততক্ষণে সিঁড়ির উপরে বসে পড়েছেন। বোধহয় বিরাগীর পা স্পর্শ করবার জন্যে তাঁর হাত দুটো ছটফট করতে শুরু করেছে। জগদীশবাবু বলেন—আমার এখানে কয়েকটা দিন থাকুন বিরাগীজি। আপনার
কাছে এটা আমার প্রাণের অনুরোধ। দুই হাত জোড় করে বিরাগীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন জগদীশবাবু।
বিরাগী হাসেন—
—বাইরে খোলা আকাশ থাকতে আর ধরিত্রীর মাটিতে স্থান থাকতে, আমি এক বিষয়ীর দালান বাড়ির ঘরে থাকব কেন, বলতে পারেন?
—বিরাগীজি! জগদীশবাবুর গলার স্বরের আবেদন করুণ হয়ে ছলছল করে।
বিরাগী বলেন—না, আপনার এখানে জল খেয়েছি, এই যথেষ্ট। পরমাত্মা আপনার কল্যাণ করুন। কিন্তু আপনার এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
জগদীশবাবু—তবে অন্তত একটু কিছু আজ্ঞা করুন, যদি আপনাকে কোনো...।
বিরাগী—না না, আমি যার কাছে পড়ে আছি, তিনি আপনার চেয়ে কিছু কম নয়। কাজেই আপনার কাছে আমার তো কিছু চাইবার দরকার হয় না।
জগদীশবাবু—তবে কিছু উপদেশ শুনিয়ে যান বিরাগীজি, নইলে আমি শান্তি পাব না।
বিরাগী—ধন জন যৌবন কিছুই নয় জগদীশবাবু। ওসব হলো সুন্দর সুন্দর এক-একটি বঞ্চনা। মন-প্রাণের সব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শুধু সেই একজনের আপন হতে চেষ্টা করুন, যাঁকে পেলে এই সৃষ্টির সব ঐশ্বর্য পাওয়া হয়ে
যায়। ...আচ্ছা আমি চলি।
জগদীশবাবু বলেন—আপনি একটা মিনিট থাকুন বিরাগীজি।
সিঁড়ির উপরে অচঞ্চল হয়ে একটা মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন বিরাগী। আজকের চাঁদের আলোর চেয়েও স্নিগ্ধ হয়ে এক জ্যোৎস্না যেন বিরাগীর চোখ থেকে ঝরে পড়ছে। ভবতোষ ফিসফিস করে—না না, ওই চোখ কি হরিদার চোখ হতে পারে? অসম্ভব!
জগদীশবাবুর হাতে একটা থলি। থলির ভিতরে নোটের তাড়া। বিরাগীর পায়ের কাছে থলিটাকে রেখে দিয়ে ব্যাকুল স্বরে প্রার্থনা করেন জগদীশবাবু—এই প্রণামী, এই সামান্য একশো এক টাকা গ্রহণ করে আমাকে শান্তি দান করুন বিরাগীজি। আপনার তীর্থ ভ্রমণের জন্য এই টাকা আমি দিলাম।
বিরাগী হাসেন—আমার বুকের ভিতরেই যে সব তীর্থ। ভ্রমণ করে দেখবার তো কোনো দরকার হয় না। জগদীশবাবু—আমার অনুরোধ বিরাগীজি...।
বিরাগী বলেন—আমি যেমন অনায়াসে ধুলো মাড়িয়ে চলে যেতে পারি, তেমনই অনায়াসে সোনাও মাড়িয়ে চলে যেতে পারি।
বলতে বলতে সিঁড়ি থেকে নেমে গেলেন বিরাগী। একশো এক টাকার থলিটা সিঁড়ির উপরেই পড়ে রইল।
সেদিকে ভুলেও একবার তাকালেন না বিরাগী।
—কী করছেন হরিদা কী হলো? কই? আজ যে বলেছিলেন জবর খেলা দেখাবেন, সে-কথা কি ভুলেই গেলেন।
আজকের সন্ধ্যাটা ঘরে বসেই কাটিয়ে দিলেন কেন?
বলতে বলতে আমরা সবাই হরিদার ঘরের ভিতরে ঢুকলাম।
হরিদার উনানের আগুন তখন বেশ গনগনে হয়ে জ্বলছে। উনানের উপর হাঁড়িতে চাল ফুটছে। আর, একটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে হরিদা চুপ করে বসে আছেন। আমাদের দেখতে পেয়েই লজ্জিতভাবে হাসলেন।
—কী আশ্চর্য! চমকে ওঠে ভবতোষ। —হরিদা, আপনি তাহলে সত্যিই বের হয়েছিলেন! আপনিই বিরাগী?
হরিদা হাসেন—হ্যাঁ রে ভাই।
ওই তো সেই সাদা উত্তরীয়টা পড়ে রয়েছে মাদুরের উপর, আর সেই ঝোলাটা আর সেই গীতা।
অনাদি বলে—এটা কী কাণ্ড করলেন, হরিদা? জগদীশবাবু তো অত টাকা সাধলেন, অথচ আপনি একেবারে খাঁটি সন্ন্যাসীর মতো সব তুচ্ছ করে সরে পড়লেন? হরিদা—কী করব বল? ইচ্ছেই হলো না। শত হোক...।
ভবতোষ—কী?
হরিদা—শত হোক, একজন বিরাগী সন্ন্যাসী হয়ে টাকা-ফাকা কী করে স্পর্শ করি বল? তাতে যে আমার ঢং নষ্ট হয়ে যায়।
কী অদ্ভুত কথা বললেন হরিদা! হরিদার একথার সঙ্গে তর্ক চলে না। আর, বুঝতে অসুবিধে নেই, হরিদার জীবনের ভাতের হাঁড়ি মাঝে মাঝে শুধু জল ফুটিয়েই সারা হবে। অদৃষ্ট কখনও হরিদার এই ভুল ক্ষমা করবে না।
অনাদি বলে—কিন্তু আপনি কি জগদীশবাবুর কাছে গিয়ে আর কখনও...।
চেঁচিয়ে হেসে ওঠেন হরিদা—যাবই তো। না গিয়ে উপায় কী? গিয়ে অন্তত বকশিশটা তো দাবি করতে হবে?
—বকশিশ? চেঁচিয়ে ওঠে ভবতোষ। সেটা তো বড়োজোর আট আনা কিংবা দশ আনা।
হরিদা বিড়ি মুখে দিয়ে লজ্জিতভাবে হাসেন—কী আর করা যাবে বল? খাঁটি মানুষ তো নয়, এই বহুরূপীর জীবন এর বেশি কী আশা করতে পারে?
লেখক পরিচিতি:
সুবোধ ঘোষ (১৯১০ – ১৯৮০) : প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ বিহারের হাজারিবাগে জন্মগ্রহণ করেন। আদিনিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর মহকুমার বহর গ্রামে। বিচিত্র কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ এই লেখকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো—‘পরশুরামের কুঠার’, ‘শুক্লাভিসার’, ‘ফসিল’, ‘তিলাঞ্জলি’, ‘গঙ্গোত্রী’, ‘একটি নমস্কারে', ‘ত্রিযামা’, ‘ভারত প্রেমকথা’, ‘জতুগৃহ’, ‘কিংবদন্তীর দেশে’, ‘ভারতীয় ফৌজের ইতিহাস’, ‘ক্যাকটাস’ইত্যাদি। ছোটোগল্প ছাড়াও তিনি বহু উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী’ স্বর্ণপদক লাভ করেন।