অদল বদল | পান্নালাল প্যাটেল
অদল বদল
পান্নালাল প্যাটেল
অদল বদল : হোলির দিনের পড়ন্ত বিকেল। নিম গাছের নীচে গাঁয়ের একদল ছেলে জড়ো হয়ে ধুলো ছোড়াছুড়ি করে খেলছিল। হাত ধরাধরি করে অমৃত ও ইসাব ওদের কাছে এল। দুজনের গায়েই সেদিনকার তৈরি নতুন জামা। রং, মাপ, কাপড় - সব দিক থেকেই একরকম। এরা দুজনে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। রাস্তার মোড়ে এদের বাড়ি দুটোও মুখোমুখি। দুজনের বাবাই পেশায় চাষি, জমিও প্রায় সমান সমান। দুজনকেই সাময়িক বিপদ আপদে সুদে ধার নিতে হয়। বলতে গেলে ছেলেদুটোর সবই একরকম, তফাত শুধু এই যে, অমৃতের বাবা-মা আর তিন ভাই রয়েছে, ইসাবের আছে শুধু তার বাবা। দুই বন্ধুতে মিলে শান-বাঁধানো ফুটপাথে এসে বসতে, ওদের একরকম পোশাক দেখে দলের একটি ছেলে বলল, “ঠিক, তোরা দুজনে কুস্তি কর তো, দেখি তোরা শক্তিতেও সমান-সমান, না একজন বড়ো পালোয়ান।' আরেকটি ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘লড়ে যা তোরা, বেশ মজা হবে।' ইসাব অমৃতের দিকে তাকাল। অমৃত দৃঢ়স্বরে বলল, ‘না, তাহলে মা আমাকে ঠ্যাঙ্গাবে।' অমৃতের অত জোর দিয়ে বলার কারণ ছিল। বাড়ি থেকে বেরাবার সময় ওর মা সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘নতুন জামা পাবার জন্য তুমি কী কাণ্ডটাই না করেছিলে; এখন যদি তুমি জামা ময়লা করে বা ছিঁড়ে আসো, তাহলে তোমার কপালে কী আছে মনে রেখো।' অমৃত সত্যি তার বাবা-মাকে খুব জ্বালিয়েছিল। শোনা মাত্র অমৃত ফতোয়া জারি করে দিল, ঠিক ইসাবের মতো জামাটি না পেলে ও স্কুলে যাবে না। মা ওকে অনেক বুঝিয়েছিল, ‘ইসাবকে ক্ষেতে কাজ করতে হয় বলে ওর জামা ছিঁড়ে গেছে, আর তোরটা তো প্রায় নতুনই রয়েছে।' ‘মোটেই না,’ বলে কাঁদতে কাঁদতে অমৃত ওর জামার একটা ছেঁড়া জায়গায় আঙুল ঢুকিয়ে আরো ছিঁড়ে দেয়। মা তখন ওকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বললেন, 'নতুন জামা দেবার আগে ইসাবের বাবা ওকে খুবমেরেছিলেন, তুইও সেরকম মার খেতে রাজি আছিস?’ অমৃত এতেও পিছপা হতে রাজি নয়। ও মরিয়া হয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমাকে বেঁধে রাখো! মারো! কিন্তু তোমাকে ইসাবের মতো একটা জামা আমার জন্য জোগাড় করতেই হবে।'
অমৃতের মা এসব ঝামেলা থেকে বাঁচবার জন্য বললেন, “ঠিক আছে, তোর বাবাকে গিয়ে বলগে।'
অমৃত জানত মা ‘না’ বললে ওর বাবার রাজি হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু অত সহজে হাল ছাড়ার
পাত্রও সে নয়। ও স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল, খাওয়া ছেড়ে দিল এবং রাত্তিরে বাড়ি ফিরতে রাজি হলো না।
শেষমেশ ওর মা হাল ছেড়ে দিয়ে অমৃতের বাবাকে ওর জন্য নতুন জামা কিনে দিতে রাজি করালেন। এর পর
উনি গিয়ে ইসাবের বাবার গোয়ালঘর থেকে লুকিয়ে থাকা অমৃতকে বাড়ি নিয়ে এলেন।
সুন্দর সাজগোজ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অমৃতের একেবারেই ইচ্ছে ছিল না জামাকাপড় নোংরা হয়
এমন কিছু করতে। বিশেষ করে ইসাবের সঙ্গে কুস্তি লড়তে তো একেবারেই গররাজি।
এমন সময় ছেলেছোকরার দঙ্গল থেকে একজন এসে হাত দিয়ে অমৃতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘এসো, আমরা কুস্তি লড়ি।'
এই বলে সে অমৃতকে খোলা মাঠে নিয়ে এল। অমৃত ওর বাঁধন কেটে বেরুবার চেষ্টা করতে করতে বলল,
‘দেখ কালিয়া, আমি কুস্তি লড়তে চাই না, আমাকে ছেড়ে দে।' কালিয়া তো ওকে ছাড়লই না, বরং ছুঁড়ে মাটিতে
ফেলে দিল। ছেলের দল আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কালিয়া জিতেছে, অমৃত হেরে গেছে, কী মজা, কী মজা।”
ইসাবের মেজাজ চড়ে গেল। ও কালিয়ার হাত ধরে বলল, ‘আয়, আমি তোর সঙ্গে লড়ব।' কালিয়া
ইতস্তত করছিল, কুস্তি শুরু হয়ে গেল। ইসাব ল্যাং মারতে কালিয়া ব্যাঙের মতো হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে পড়ে
গিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল।
তামাশা করে হলেও এখন ব্যাপারটা ঘোরালো হয়ে পড়েছে এবং কালিয়ার বাবা-মা এসে ওদের পিটুতে
পারে বুঝতে পেরে সবাই যে যেদিকে পারে পালিয়ে গেল।
অমৃত আর ইসাবও রণভূমি ত্যাগ করল। কিছুটা যেতেই অমৃতের নজরে এল যে ইসাবের জামার পকেট
ও ছ'ইঞ্চি পরিমাণ কাপড় ছিঁড়ে গেছে। ওরা ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। ওরা জামা কতটা ছিঁড়েছে পরীক্ষা করছে,
এমন সময় শুনতে পেল ইসাবের বাবা ইসাবকে ডাকছেন।
ওদের তখন বুকের ধুকপুকুনি বন্ধ হবার জোগাড়, ওরা জানে ইসাবের বাবা ছেঁড়া শার্ট দেখা মাত্র ওর
চামড়া তুলে নেবে। উনি সুদখোরের কাছ থেকে টাকা ধার করে অনেক বাছাবাছি করে কাপড় কিনে জামা সেলাই করিয়েছিলেন।
ইসাবের বাবা আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কে কাঁদছে, ইসাব কোথায়?’
হঠাৎ অমৃতের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল, ও ইসাবকে টানতে টানতে বলল, ‘আমার সঙ্গে আয়।”
ওদের দুই বাড়ির মাঝখানে ঢুকে অমৃত জামার বোতাম খুলতে লাগল। ও হুকুম দিল, ‘তোর জামা খুলে আমারটা পর।'
ইসাব বলল, ‘তোর কী হবে, তুই কী পরবি?’
অমৃত বলল, ‘শিগগির কর, নয়তো কেউ দেখে ফেলবে। আমি তোরটা পরব।'
‘ইসাব জামা খুলতে লাগল, যদিও অমৃত কী করতে চাইছে বুঝতে পারছিল না, বলল,
কিন্তু তাতে সুবিধাটা কী হবে, তোকে তো তোর বাবা পিটোবে।'
“জামা অদল-বদল?
অমৃত বলল, ‘নিশ্চয় ঠ্যাঙ্গাবে, কিন্তু আমাকে বাঁচানোর জন্য তো আমার মা আছে।
ইসাবের মনে পড়ল, ও দেখেছে যে, অমৃতের বাবা যখনই মারতে গেছেন, অমৃত ওর মায়ের পেছনে
লুকিয়েছে। মার হাতে অবশ্য ওকে দু’চার থাপ্পড় খেতে হয়েছে, কিন্তু বাবার ভারী হাতের মারের কাছে ও কিছুই নয়।
ইসাব তবু ইতস্তত করছে, এমন সময় সে খুব কাছে কাউকে কাশতে শুনল, তক্ষুণি ওরা ঝটপট জামা
অদল-বদল করে, গলি থেকে বেরিয়ে ধীরে সুস্থে নিঃশব্দে যে যার বাড়ির দিকে চলল।
ভয়ে অমৃতের বুক ঢিপঢিপ করছিল। কিন্তু ওর কপাল ভালো দিনটা ছিল হোলির, সে সময় সবাই জানে
কিছুটা ধস্তাধস্তি টানা হ্যাঁচড়া চলে। মা যখন দেখলেন জামাটা ছিঁড়েছে, উনি ভুরু কুঁচকোলেন কিন্তু মাফ করে
দিলেন। একটা সুঁচসুতো নিয়ে ছেঁড়া জামাটা রিফু করে দিলেন।
এতে দুজনেরই ভয় কেটে গেল, ওরা আবার হাত ধরাধরি করে গ্রামের ধারে হোলির সময়কার বাজি আর বুড়ির বাড়ি পোড়ানো দেখতে গেল।
একটা ছেলে ওদের জামা বদলানো দেখেছিল, সে ওদের আনন্দ মাটি করার জন্য বলল, ‘তোরা অদল-বদল করেছিস, হুম্।'
সে তাদের জামা অদল-বদল করা দেখে ফেলেছে এই আশঙ্কা করে তারা চলে যেতে চাইল। কিন্তু ইতিমধ্যে অন্য ছেলেরাও কি ঘটেছে জেনে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘অদল-বদল, অদল-বদল!’ অমৃত আর ইসাব সরে
পড়তে চাইল, কিন্তু ছেলের দল তাদের পেছনে পেছনে ‘অদল-বদল, অদল-বদল!’ বলে চ্যাঁচাতে লাগল।
বাবারা তাদের ব্যাপারটা জেনে ফেলবে মনে করে তারা ভয়ে বাড়ির দিকে ছুটে পালাতে লাগল।
ইসাবের বাবা বাড়ির সামনের দাওয়ায় খাটিয়ায় বসে হুঁকো খাচ্ছিলেন, তিনি ওদের ডাকলেন, ‘তোমরা বন্ধুদের কাছ থেকে পালিয়ে আসছ কেন? আমার কাছে এসে বসো।'
ওঁর শান্ত গলা শুনে ওদের চিন্তা হলো, ভাবল, ‘যা ভেবেছিলাম তাই হলো, উনি আসল ঘটনাটা জানেন, শুধু ভালোবাসার ভান করছেন।'
ইসাবের বাবা পাঠান, উনি দশ বছরের অমৃতকে জড়িয়ে ধরলেন। চেঁচিয়ে বললেন, ‘বাহালি বৌদি, আজ থেকে আপনার ছেলে আমার।' বাহালি বৌদি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হাসতে হাসতে বললেন, ‘হাসান ভাই, আপনি এক ছেলেকেই দেখে উঠতে পারেন না, তা দুজনকে কী করে সামলাবেন??
আবেগ ভরা গলায় হাসান বললেন, ‘বাহালি বৌদি, অমৃতের মতো ছেলে পেলে আমি একুশজনকেও পালন করতে রাজি আছি।'
কেশে গলা পরিষ্কার করে পাঠান বাহালি বৌদিকে বললেন, ‘ছেলে দুটোকে গলিতে ঢুকতে দেখেই ভেবে নিলাম, দেখতে হবে ওরা কী করে।’ পাড়া-পড়শি মায়ের দল পাঠানের গল্প শোনার জন্য ঘিরে দাঁড়াল। উনি অল্প কথায় ছেলেদের জামা বদলের গল্পটা বললেন, আরো বললেন, ‘ইসাব অমৃতকে জিজ্ঞেস
করেছিল, তোর বাবা যদি তোকে মারে কী হবে? অমৃত কী জবাব দিয়েছিল জানেন? বলেছিল কিন্তু আমার তো মা রয়েছে।'
সজল চোখে পাঠান বললেন, ‘কী খাঁটি কথা! অমৃতের জবাব আমাকে বদলে দিয়েছে। ও আমাকে শিখিয়েছে, খাঁটি জিনিস কাকে বলে।'
অমৃত ও ইসাবের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার গল্প শুনে তাঁদেরও বুক ভরে গেল।
ইতিমধ্যে ছেলের দল বাজি আর বুড়ির বাড়ি পোড়ানো দেখে ফিরছিল। তারা ইসাব অমৃতকে ঘিরে বলতে লাগল, ‘অমৃত-ইসাব- অদল-বদল, ভাই অদল-বদল।'
এবার অবশ্য ইসাব ও অমৃত অপ্রস্তুত বোধ করল না, বরঞ্ অদল-বদল বলাতে তাদের ভালোই লাগল।
অদল-বদলের গল্প গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্রাম-প্রধানের কানে গেল। উনি ঘোষণা করলেন, ‘আজ থেকে আমরা অমৃতকে অদল আর ইসাবকে বদল বলে ডাকব।' ছেলেরা খুব খুশি হলো, ক্রমশ গ্রাম পেরিয়ে আকাশ বাতাসও ‘অমৃত-ইসাব অদল-বদল, অদল-বদল’ এই আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠল।
তরজমা : অর্ঘ্যকুসুম দত্তগুপ্ত
পান্নালাল প্যাটেল (১৯১২-১৯৮৯) : গুজরাতি ভাষার প্রসিদ্ধ লেখক পান্নালাল প্যাটেল রাজস্থানের দুঙ্গারপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সাধারণ মানুষ আর গ্রামজীবন তাঁর রচনায় প্রধান গুরুত্ব পেয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতি বিষয়েও তিনি বিশেষ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পসংগ্রহ ‘সাচা সম্মান’, ‘জিন্দেগি কা খেল’, ‘লাখ চোরাসি’, ‘সুখ দুখনান সাথী’, ‘কোই দেশি কোই পরদেশি’, ‘আসমানি নজর’ প্রভৃতি। সাহিত্যকীর্তির জন্য তিনি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে রঞ্জিত রাম সুবর্ণচন্দ্রক এবং ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন।